পর্ব-১ :- #হাত_রিকশা
বাইরে থেকে পর্যটক এলে কিংবা প্রবাসী কোনো আত্মীয় বাড়িতে এসে হাজির হলে কিম্বা হঠাৎ এক ঘেয়েমির মন খারাপ গুলো কে কাটিয়ে তুলতে,আবার শীতকাল এলেই দেখবেন প্রাণের শহর কোলকাতায় আনাচে কানাচে বেড়ানোর হিড়িক;সেই চেনা জায়গা গুলো বারবার শিরোনামে,যেমন চিড়িয়াখানা,ভিক্টোরিয়া,বিড়লা,সেন্ট পলস,নন্দন….আরও কতো,কিন্তু এর মাঝেই কি কোলকাতার হারানো কিছু আভিজাত্য কে ছুঁয়ে দেখা যায়না??এসব ভাবতে ভাবতেই,মনে মনে আউড়ে নি “চল রাস্তায় সাজি ট্রাম-লাইন/আর কবিতায় শুয়ে কাপলেট্..”তাই কয়েকটি পর্বে কিছু প্রায় হারিয়ে যাওয়া গৌরব কে..বিস্মৃতির শহর তিলোত্তমাকে হারিয়ে খুঁজে ফিরি আমরা..
কলকাতা শহর পুরনো শহর। ঐতিহ্য সম্পন্ন শহর। কলকাতার ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাতে টানা রিক্সা। আজও উত্তর কলকাতায় গেলে চোখে পরে একটা মানুষের আরেকটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কানে ঠুং ঠুং আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ছোটবেলায় যখন বাবার হাত ধরে কলকাতা শহর দেখতাম, তখন সবচেয়ে মজা লাগত হাতে টানা রিক্সা দেখে। মনে মনে ভাবতাম উফঃ কত শক্তি ওই রিক্সা কাকুটার শক্তিমানকেও হারিয়ে দেবে শক্তির জোরে। আজ যখন দেখি তখন নিজের উপর হাসি পায়। শহর আজ বিশ্বায়নের সাজে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। পুরনো ঐতিহ্যের অনেক কিছু নতুন ধ্যানধারণায় পরিবর্তিত হয়েছে। শুধু রয়ে গিয়েছে কিছু হাতে টানা রিক্সা।
॰ শব্দগত ব্যুৎপত্তিসম্পাদনা
বাংলা ‘রিকশা’ শব্দটি এসেছে জাপানী ‘জিন্রিকিশা’ (人力車, 人 জিন্ = মানুষ, 力রিকি = শক্তি, 車 শা = বাহন) শব্দটি থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘মনুষ্যবাহিত বাহন’।
॰ রিকশার ইতিহাস
হাতে টানা রিক্সা বা হাত রিক্সা প্রথম চালানো শুরু হয় জাপানে।পালকির বিকল্প হিসেবে ১৮৬৫-৬৯ প্রথম কে এর উদ্ভাবন করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো -জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানের সিমলায়। ১৯০০ সালে কলকাতায়, তবে মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ততদিনে ব্রক্ষদেশ মানে মিয়ানমারের রেঙ্গুনেও রিকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আজও চলছে সেই উনিশকে শুরু হওয়া ঐতিহ্য। টুরিস্টদের কাছে কলকাতায় দেখার মত অন্যতম একটি বিষয় আজও এই হাত রিক্সা।
॰ ঠিক কীরকম দেখতে এই হাত রিক্সা
সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি হয় এই হাত রিক্সা। রিক্সার চাকা দুটো তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। আকারে বড় হয় ও মোটা হয় চাকা দুটো। বসার জন্য যে জায়গা থাকে তা লোহা দিয়ে বানানো হয়। পা রাখার জায়গা থেকে রিক্সা টেনে নিয়ে যাওয়ার হাতল জোড়া থাকে। রিক্সা যিনি চালান তিনি হাতল ধরে সামনের দিকে রিক্সাকে টেনে নিয়ে যান। যাত্রীর সুবিধার কথা মাথায় রেখে ভালো মানের কাঠ দিয়ে ও দক্ষ কারিগর দিয়ে বানানো হয় এই রিক্সা। বৃষ্টির দিনে উঁচু নিচু রাস্তা খানাখন্দর কথা মাথায় রেখেই ভালো মানের কাঠ ও কারিগর দিয়ে রিক্সা তৈরি হয়।
॰ প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
॰ এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
॰ হাত রিক্সার কলকাতাযাপন
কলকাতায় উনিশশতকে সেই যে পথ চলা শুরু হাত রিক্সার তা আজও প্রবাহমান। কালের গতি কিছুটা হলেও এই গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে তিলোত্তমা কলকাতার বুকে আজ দেখা মেলেনা খুব একটা এই রিক্সার। উত্তর কলকাতার অলিগলিতে গেলে দেখতে পাবেন। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাবে এ দৃশ্য অমানবিক। কলকাতাবাসী সবসময় মানবিক তাই তারা এই অমানবিকতাকে প্রশয় দেয় না আজ। সরকার থেকেও এই হাত রিক্সা চালানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রায় ১৭হাজার মানুষ এই পেশার সাথে যুক্ত তাই অন্নের তাগিদে আইন অমান্য করে আজও রিক্সা চালাছে তারা।
শহরের সাথে সাথে সিনেমাতেও কলকাতার হাতে টানা রিক্সা অনেকবার দেখা গিয়েছে।বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জামিন’ সিনেমা আশাকরি কম বেশি সবার দেখা। ছবিটিতে প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাতে টানা রিক্সা দেখা যায়। গ্রামীণ এক কৃষকের কাজের সন্ধানে শহরে আসা ও রিক্সাকে জীবিকা বানানোর গল্প। দুটো হাতে টানা রিক্সার রেষারেষিকে কেন্দ্র করে পুরো সিনেমাটা।আরেকটি সিনেমা ‘সিটি অফ জয়’ যেখানে রিক্সাওয়ালার চরিত্রে ওম পুরিকে দেখা গিয়েছিল। ভারতীয় চলচিত্রের দুনিয়াতে অনেক সিনেমাই আছে যাতে হাতে টানা রিক্সাকে বারবার দেখানো হয়েছে।হাতে টানা রিক্সা ও রিক্সাওয়ালার কাহিনী নিয়ে অসাধারণ একটি বই আছে। বইটি বিখ্যাত লেখক ডোমেনিক ল্যাপিইয়ারের লেখা। ‘সিটি অফ জয়’। এই বইতে কলকাতার হাত রিক্সা ও তার চালকদের জীবনের গল্প সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
কলকাতার ঐতিহ্যর বাহক হয়ে হাত রিক্সার যাত্রা আবহমানকাল থাকবে না হয়তো, কিন্তু কলকাতার ইতিহাসে রিক্সার গল্পকথা অমর হয়ে থাকবে..।
©️শঙ্খচিল
তথ্যসূত্র:-ব্যক্তিগত,গুগল