ইতিহাস এবং মুর্শিদাবাদ যেন একে অপরের হাত ধরে হাটে। কখনো এ ইতিহাস নবাবদের কখনো বা ওলন্দাজ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আবার তা আবর্তিত হয়েছে স্থানীয় জমিদারদের ঘিরে। এ ইতিহাস গৌরবের, ষড়যন্ত্রের। আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের কাহিনী গুলোর মধ্যে জড়িয়ে আছে স্থানীয় গল্পগাথা, তৈরি হয়েছে মিথ। এমনি এক ইতিহাস আর গল্প মাখা কাহিনী মুর্শিদাবাদের বরনগর এর রানী ভবানীর মন্দির গুচ্ছের। যেখানে আজ ও পোড়ামাটির ইট কথা বলে। কথা বলে ভাঙা দেউল। বহু প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে আজও অক্ষত থেকে গেছে চার বাংলা মন্দির, ভবানিশ্বর মন্দির ও গঙ্গেশ্বর মন্দির। ছড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু ভগ্নপ্রায় মন্দির, জমিদারী গৃহ।
এ কাহিনীর গন্ডী বরনগরে সীমাবদ্ধ নয়, এর বিস্তৃতি রাজশাহীর নাটোর পর্যন্ত। নবাবী আমলে প্রায় সব জমিদারদের ই মুর্শিদাবাদে আবাস গৃহ ছিল। নাটোর রাজবংশের মুর্শিদাবাদ আবাস ছিল ভাগীরথীর পশ্চিম পারে আজিমগঞ্জ থেকে 2.5 km দূরের বরনগরে। অনেকের মতে নাটোর রাজবংশের গঙ্গাবাস ছিল বরনগর। এই রাজবংশের আদি পুরুষ ধরা হয় রঘুনন্দন কে। তিনি একসময় পুটিয়ার রাজকর্মচারী ছিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁ এর (1717-1727) রাজত্বকালের কোনো একসময় তিনি মুর্শিদাবাদে আসেন এবং নিজ বুদ্ধিমত্তার জোরে একসময় তাঁর নায়েব পদপ্রাপ্তি ঘটে। মুর্শিদকুলি খাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র রঘুনন্দন প্রভূত জমি ও জমিদারির মালিক হন। সমস্ত জমি ও জমিদারী তিনি নিজ ভাই রামজীবনের নামে নথিভুক্ত করেন। একসময় নাটোরের জমিদারী রামজীবনের হস্তগত হয়। রামজীবনের পুত্র ছিলেন কালিকাপ্রসাদ যিনি নিঃসন্তান ছিলেন। কালিকাপ্রাসাদের দত্তক পুত্রের নাম রামকান্ত। রামজীবনের মৃত্যুর পর সমগ্র জমিদারির মালিক হন রামকান্ত। রানী ভবানী এই রামকান্তের স্ত্রী।
রানী ভবানী ছিলেন রাজশাহী জেলার অন্তঃপাতি ছাতিম গ্রামের আত্মারাম চৌধুরীর কন্যা। মায়ের নাম জয়দুর্গা দেবী। 1746 সালে রামকান্তের জীবনাবসান ঘটলে নাটোরের জমিদারির উত্তরাধিকারিনী হন রানী ভবানী। কথিত আছে সেসময় নাটোর এত বড় জমিদারী ছিল যে প্রতি বছর দেড় কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হতো। রানী ভবানীর একমাত্র সন্তানের নাম তারাসুন্দরী এবং দত্তক পুত্রের নাম রামকৃষ্ণ। অত্যন্ত প্রজাবৎসল ছিলেন রানী ভবানী। দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণ প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তিনি সমস্ত জমিদারির ভার রামকৃষ্ণের হাতে অর্পণ করে ভাগীরথীর তীরে নাটোর জমিদারির গঙ্গাবাস বা মুর্শিদাবাদবাস বরনগরে এসে বসবাস শুরু করেন, তাঁর সঙ্গী হন কন্যা তারাসুন্দরী।
বরনগর কে রানী ভবানী কাশীর প্রতিরূপ রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে তিনি এই অঞ্চলে 108 টি শিব মন্দির এক রাতের মধ্যে নির্মাণের নির্দেশ দেন। সমস্ত নির্মাণ প্রায় হয়ে গেলেও একটি মন্দিরের ছাদ নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকায় তাঁর ইচ্ছে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দির গুলির মধ্যে তিনটি আজ ও অক্ষত। বাংলার নিজস্ব মন্দির গঠনশৈলীর সমস্ত বৈশিষ্ট বহনকারী এই মন্দির গুলি টেরাকোটার কাজের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের দেউল শৈলী থেকে উনিশ শতকের দোল মঞ্চ শৈলী পর্যন্ত বাংলার নিজস্ব মন্দির শৈলীর বিবর্তনের প্রায় শেষলগ্নের বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হয় বরনগরের মন্দিরগুচ্ছে। এগুলির নির্মাণ সময়কাল অষ্টদশ শতক।
বরনগরের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় মন্দিরটি হলো চারবাংলা মন্দির। বাংলার মন্দির শৈলীতে ‘বাংলা’ শব্দের অর্থ হলো অবয়ব (structure) বা বলা যায় মন্দিরের সংখ্যা। যেমন ‘একবাংলা’ অর্থে একসাথে একটি মন্দির, ‘জোড়বাংলা’ অর্থে একসাথে দুটি মন্দির, তেমনি ‘চারবাংলা’ অর্থে একসাথে চারটি মন্দিরের সমাহার। বস্তুত বাংলায় এমন চারবাংলা শৈলীর মন্দিরের নিদর্শন বিশেষ দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব বিভাগের ফলক অনুসারে এর নির্মাণকাল 1755 সাল। রানী ভবানী কতৃক নির্মিত মন্দির গুলির মধ্যে বর্তমানে এটির অবস্থা সবথেকে ভালো। ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু মঞ্চের উপর অবস্থিত চারদিকে চারটি মন্দির নিয়ে গঠিত হয়েছে এই চারবাংলা মন্দির। প্রতিটি পৃথক মন্দিরে তিনটি করে দরজা এবং প্রতিটিতে তিনটি করে মোট বারো টি শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দির গুলি ‘দোচালা’ অর্থাৎ দুটি ঢাল যুক্ত ছাদ বিশিষ্ট। উত্তর ও পশ্চিমের মন্দিরের টেরাকোটার কাজ অনবদ্য এবং এখনও তা অক্ষত। পূর্ব দিকের মন্দিরের কারুকার্য চুন নির্মিত। রামায়ণ–মহাভারতের কাহিনী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী, দশাবতার, শুম্ভ নিশুম্ভের যুদ্ধ, শিকার, শোভাযাত্রা, হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি টেরাকোটার কাজের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উত্তরের মন্দিরের নন্দী ভিঙ্গি সমেত ভগবান শিবের মূর্তিটি বিশেষ উল্লেখ রাখে। এর ঠিক পাশেই অবস্থান করছে রাজা বিশ্বনাথের ভগ্নপ্রায় কাছারি বাড়ি। চারবাংলা মন্দিরের পাশ দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে গঙ্গা–ভাগীরথী নদী। নদী ভাঙ্গনের ফলে মন্দিরটি আজ বিপন্ন। আশার কথা রাজ্য সরকারের সহায়তায় মন্দির সংলগ্ন নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঁধানো হয়েছে ভাঙ্গন গ্রস্ত নদীর পাড়।
চারবাংলা মন্দিরের অদূরেই অবস্থান করছে ভবানীস্বর মন্দির, যেখানে পূজিত হন ভগবান শিব। কে নির্মাণ করেছেন এবং কবে নির্মিত হয়েছে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে রানী ভবানী আবার কারো মতে কন্যা তারাসুন্দরী এর নির্মাণ করেন। নির্মাণকাল হিসেবে 1755 সাল কেই ধরা হয়। মন্দিরটি অষ্ঠকোনী গঠনের। মন্দিরের ছাদ আটকোনা এবং দেখতে অনেকটা উল্টোনো পদ্মের মত। ছাদের উপর একটি বৃহৎ গম্বুজ রয়েছে যাকে একরত্ন গঠনের সাথে তুলনা করা চলে। আটকোনা ছাদের নিচে আট টি দেওয়াল এবং আট টি প্রবেশ পথ বর্তমান। সমগ্র মন্দিরটি চুন, সুড়কি নির্মিত এবং কারুকার্য সমন্বিত, যদিও তার বেশির ভাগ ই আজ ক্ষতিগ্রস্ত। বরনগরের মন্দির গুলির মধ্যে ভবানিশ্বর মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা উচ্চতম। এর অনতিদূরেই আটকোনা ভগ্নপ্রায় দুটি মন্দির রয়েছে। কাশী অর্থাৎ বর্তমান বারাণসী তেও রানী ভবানী ভবানিশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথিত আছে এই দুটি মন্দিরের সময়কাল এক ই। বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই মন্দিরটিকে সাম্প্রতিক সময়ে এ সংস্কার করা হয়েছে।
ভবানিশ্বর মন্দিরের অদূরে রানী ভবানীর জমিদার বাড়ি আর ঠিক এর কিছু পরেই অবস্থান করছে গঙ্গেশ্বর মন্দির। আনুমানিক 1753 সালে রানী ভবানী নির্মিত এই মন্দিরটি ‘জোড়বাংলা’ শৈলীর। অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের তিনটি দরজা এবং অভ্যন্তরে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরের টেরাকোটার কাজের বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন জন্তু, মানুষের কারুকার্য এবং কৃষ্ণলীলা সমৃদ্ধ থাম গুলি বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়। এই মন্দিরটিও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত।
বহু বছরের অবহেলা, অযত্ন, মানুষের লোভ–লালসা, প্রকৃতির রোষের বলি বরনগরের মন্দির গুচ্ছ। বহু মন্দির হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। চুরি গেছে মন্দিরের ইট এমনকি বিগ্রহ। রক্ত চক্ষু দেখাচ্ছে ভাগীরথীর ভাঙ্গন। আশার আলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে,ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নদী ভাঙ্গন রোধের। উন্নতি সাধন করা হয়েছে সংলগ্ন রাস্তার। নিরন্তর প্রচারের ফলে কলকাতা থেকে ফারাক্কাগামী রিভার ক্রুসের ঐতিহাসিক পর্যটন সফরে সওযারি হচ্ছে বহু বিদেশি পর্যটক। আগমন ঘটছে বহু সাধারণ উৎসাহী পর্যটকের। মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে সর্বক্ষণের কর্মী, নিযুক্ত হয়েছে নিত্য পুজোর পুরোহিত। নবাবী মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত হাজারদুয়ারী, লালবাগ, খোশবাগ দর্শনের সাথে আর একটু উত্তরে এগিয়ে জমজ শহর জিয়াগঞ্জ–আজিমগঞ্জ সন্নিহিত বরনগর এর মন্দির গুচ্ছের দর্শন খুব সহজেই করা যায়। নদী পথে লঞ্চে ভ্রমণ ও সমানভাবে জনপ্রিয় এখানে। ভাগ্য সাথে থাকলে উপরি পাওনা জাতীয় জলজ প্রাণী শুশুক এর দর্শন। প্রাচীন বাংলার নিজস্ব মন্দির শৈলীর নিদর্শন মুর্শিদাবাদের কাশী খ্যাত বরনগর তাই আপনাকে স্বাগত জানায়।
বেশ ভালো
ভালো লেখা