দোলযাত্রা যেন পরাণের সঙ্গে পরাণ বাঁধার উত্সব! চির বন্ধুতার আবেগে মাখোমাখো উৎসব।বাংলার দোল সারা ভারতে হোলি। এই হোলি কথাটা এসেছে ‘হোলাক’ বা ‘হোলক’ থেকে। ভালো শস্য উত্পাদনের প্রার্থনায় এই উত্সব শুরু করেছিল মানুষ। তখন জ্বালানো হত ‘অজন্মা’ দৈত্যের খড়। আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণে ঋতুচক্রের শেষ উৎসব বসন্তের দোল। অবাঙ্গালীদের হোলিও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির উত্থানের ইতিহাস। এই রঙ উৎসবের আগের দিন ধুমধাম করে তাদের ‘হোলিকা দহন’ আর বাংলায় বৈষ্ণব প্রাধান্য রীতি অনুযায়ী চাঁচর বা ন্যাড়াপোড়া (মেড়াপোড়া)। পরের দিন রঙ খেলা। কিংবদন্তী বলছে বাসন্তী পূর্ণিমার এই দিনে কৃষ্ণবধের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ দানব দীর্ঘকেশ কেশী কে শ্রীকৃষ্ণ বধ করেন। মথুরা, বৃন্দাবনের মধ্যে প্রবাহিত যমুনার কেশীঘাটে এই কেশী নামক অসুরকে পরাজিত ও বধ করে কৃষ্ণের নাম হয় কেশব। আর ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেশী বধের আনন্দেই হোলি উত্সব।
পুরাণের এই হোলিকা দহন বা আমাদের আজকের ন্যাড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর জ্বালানো হচ্ছে অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতিক আর পরেরদিনে দোল উত্সবে আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে শুভ শক্তিকে বরণ করা। অথবা যদি ভাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে? বসন্তে ঋতু পরিবর্তনে রোগের বাড়াবাড়িকে নির্মূল করতে এই দহনক্রিয়া? আর সামাজিক কারণ হিসেবে শীতের শুষ্ক, পাতাঝরা প্রাকৃতিক বাতাবরণকে পুড়িয়ে সাফ করে কিছুটা বাসন্তী ধৌতিকরণ। সে যাইহোক দোল পূর্ণিমার আগের রাতে খেজুরপাতা, সুপুরিপাতা আর শুকনোগাছের ডালপালা জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মহা উত্সাহে নৃত্য করে করে গান গাওয়াটাই এখন সামাজিক লোকাচার।
“আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল।”
উপনিষদে বলে “আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যজনাত” অর্থাত ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। কিন্তু তিনি একা সেই কাজ করবেন কী করে? তাইতো তিনি সৃষ্টি করেন বন্ধু-বান্ধব, পিতামাতা, দাসদাসী, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রীর মত সম্পর্কের জালে আবদ্ধ মানুষদের। প্রেমের আবাহনে পুরুষ আর প্রকৃতির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে রাস, ঝুলন বা দোলের মত উত্সব। সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রজাপিতার এরূপ দায়বদ্ধতা। মানুষকে নিয়ে মানুষের যাপন। সেখানেই দোলযাত্রা নামক সম্মিলিত মিলন উৎসবের সার্থকতা!
চাঁচর উত্সবের তাৎপর্য কিছুটা পরিবেশ ভিত্তিক। বর্ষশেষের শুকনো গাছের ডালপালা, লতা গুল্ম একত্র করে লম্বা চোঙের মত বেঁধে পূর্ণিমার আগের রাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। যেন পাতাঝরা ঋতু শেষের সব আবর্জনা, গ্লানি মুছে যাক, শুচি হোক ধরিত্রী। পরিবেশের বাৎসরিক ধৌতিকরণ। পুরাণে এই আচারের নাম ‘হোলিকাদহন’। বাংলায় ন্যাড়াপোড়া বা চাঁচর। হোলিকার অর্থ ডাইনি। চাঁচর শব্দের অভিধানিক অর্থ হল কুঞ্চিত বা কোঁকড়া। কীর্তনের পদকর্তা চণ্ডিদাস লিখলেন, “চাঁচর কেশের চিকন চূড়া”।
হোলিকা দহনের উৎস হল পিতাপুত্রের চিরাচরিত ইগোর দ্বন্দ। ধর্মান্ধতার ইগো। বাবা স্বৈরাচারী দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু আর ছেলে বিষ্ণুর আশীর্বাদ ধন্য প্রহ্লাদ। বাবা বিষ্ণু বিরোধী দাপুটে রাজা তাই তাঁকে মানতেই হবে। পুত্র ঠিক উল্টো। বিষ্ণুর সমর্থক, বিষ্ণু অন্ত প্রাণ।
এদিকে তখন কশ্যপমুনির স্ত্রী দিতির দুই পুত্র। দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র দেবকুল তখন সন্ত্রস্ত। বিষ্ণু বধ করলেন হিরণ্যাক্ষকে। হিরণ্যকশিপু ভ্রাতৃহন্তা বিষ্ণুর ওপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠল। মন্দার পর্বতে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার বর পেল যে দেব, দৈত্য, দানব কেউ তাকে বধ করতে পারবেনা। হিরণ্যকশিপুর আপন দেশে বলবত্ হল নতুন আইন। কেউ বিষ্ণুপুজো করতে পারবেনা। এদিকে তার ছেলেই তো পরম বৈষ্ণব। অতএব ছেলেকে সরাও পৃথিবী থেকে। যে কেউ মারতে পারবেনা প্রহ্লাদকে। রাজ্যের সব বিষ্ণুভক্তকে তিনি শূলে চড়িয়ে মৃতুদন্ড দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের বেলায় কী করবেন? বুদ্ধি খাটালেন বাবা। সুইসাইড বম্বার চাই তাঁর। বাবার হোলিকা নামে দুষ্টু পাজী এক বোন ছিল। হোলিকার কাছে ছিল মন্ত্রপূত এক মায়া-চাদর বা ইনভিজিবল ক্লোক। অতএব হোলিকাকে কাজে লাগানো হল আত্মঘাতী মারণাস্ত্র হিসেবে।
প্রহ্লাদ বধের জন্য তৈরি হল এক বিশেষ ঘর যেখানে হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে বসল । আগুন জ্বালানো হল এমন করে যাতে ঐ মায়া চাদর হোলিকাকে রক্ষা করবে আর প্রহ্লাদ আগুনে পুড়ে মরে যাবে। কৌশল, ছলনা সবকিছুর মুখে ছাই দিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণ আসতেই অগ্নি সংযোগ হল। মায়া চাদর হোলিকার গা থেকে উড়ে গিয়ে নিমেষের মধ্যে প্রহ্লাদকে জাপটে ধরল। হোলিকা পুড়ে ছাই হল আর প্রহ্লাদ রয়ে গেল অক্ষত।
হরিনামের সূত্র ধরে মনে পড়ে যায় নবদ্বীপ-মথুরা-বৃন্দাবন সহ ভারতের সর্বত্র দোলের পরদিন হোলি উত্সবের কথা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আর রং খেলার আনন্দে সব কালিমা, বৈরিতা মুছিয়ে দেওয়া আর বার্ষিক এই উত্সবের আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। ঐতিহাসিকদের মতে পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে বদলেছে দোল পালনের রীতিনীতি। পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখে রঙের উৎসব পালন করতেন। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণে এই রঙ উৎসবের বিবরণ আছে। সপ্তম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালন, দন্ডির দশকুমারচরিত এবং শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে উল্লেখ আছে হোলির। এমনকি মুঘল মিনিয়েচারেও আছে দোলের কিছু কাহিনীচিত্র। আল বেরুনীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনও কোনও অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলির উৎসবে যোগ দিত। মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণ ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ গোপ গোপিনীদের হোরি উৎসব। ঐ দিলেই আবার হিন্দু সমাজের অন্যতম মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথিও। ইংরেজরা প্রথম দিকে ভারতবর্ষের এই উৎসবকে রোমান ফেব্রুয়ারি উৎসব ‘ল্যুপার ক্যালিয়া’ বা গ্রীক উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’র সঙ্গেও তুলনা করত। বাৎসায়নের কামসূত্র থেকে জীমূতবাহনের কালবিবেক ও ষোড়শ শতকের রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে।
পুরাণে আছে, রাক্ষসী পূতনার বুকের দুধ পানে শিশু কৃষ্ণের গায়ের রঙ বিষাক্ত হয়ে কালো হয়ে যায়। মা যশোদার মন মানত না। রাধিকার গায়ের রঙের সঙ্গে পুত্রের গায়ের রঙের তুলনা করলে মন খারাপ হত তাঁর। হোলির রঙ মাখিয়ে পুত্র কে অন্যরূপে দেখার চেষ্টায় এই ফাগ খেলা বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে সে রঙ ছিল রঙ্গিন ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে গুঁড়ো করে তা থেকে তৈরী পরিবেশ বান্ধব রঙ। এখন সেটা অনেকাংশেই রাসায়নিক।
আনন্দের এই মিলনোৎসবে বিশেষ পানীয়ের দলে জায়গা করে নিয়েছে ভাঙ মেশানো ঠাণ্ডাই শরবত। অতি যত্নে প্রস্তুত এই বিশেষ পানীয়ে ভাঙ ছাড়াও থাকে দই, দুধ, ক্ষীরের সঙ্গে মেশানো বাদাম বাটা, গোলাপ ফুলের শুকনো পাপড়ি, বাদাম কুচি আর বরফ। এই ঠাণ্ডাই আরো মহার্ঘ হয় কেশর, পেস্তা বাদাম মিশ্রিত অনুপানে।
দোলের ফাগ খেলার পর মিষ্টিমুখ মানেই মঠ, ফুটকড়াই আর মুড়কি। চিনির তৈরি অনেকটা রথের মত দেখতে সুউচ্চ স্তম্ভের মত শক্ত রঙ্গিন মিষ্টি এই মঠ। ফুটকড়াই হল ভাজা ছোলা মটরের ওপর চিনির কোটিং দেওয়া আর তার সহযোগে গুড়ের মুড়কি। দোলের দিন এই ত্রয়ী মিষ্টির জায়গা পাকা।
এই মঠ আমাদের বাংলার শতবর্ষের প্রাচীন এক মিষ্টি। সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায় প্রায় শতবর্ষ আগে এক লেখায় তাঁদের গ্রামের দোলতলার মেলার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “মেলার দোকানের বেশিরভাগ হচ্ছে মণিহারী আর খাবারের। খাবারের তালিকার মধ্যে ছিল, চিঁড়ে, মুড়কি, ছানা বর্জিত মণ্ডা, গোল্লা, রসকরা, তেলেভাজা, জিলিপি, মেঠাই, বাতাসা আর চিনির ও গুড়ের ছাঁচ। এই চিনির ছাঁচই হচ্ছে মঠ।”
ইতিহাস বলছে মঠ কিন্তু পর্তুগিজদের খাবার যার প্রথম আগমন হুগলির ব্যাণ্ডেল চার্চে। বড়দিনের সময় গির্জার আকারে ছাঁচে ঢালা কড়া চিনির রসের এই মিঠাইটিই নাকি ছিল পর্তুগিজদের প্রিয় মিষ্টি। গির্জায় যীশুর এই প্রসাদের আইডিয়া নিল বাংলার ময়রারা । বাতাসার মত পাক করে, নানারকমের রঙ মিশিয়ে বানাতে লাগল। একটা ফুটো পাত্র থেকে মাদুরের ওপর ফোঁটা ফোঁটা চিনির রস ফেলে কাঠের ছাঁচে সেই রস জমিয়ে মঠ তৈরী হল । বাংলার ময়রারা এই মিষ্টিকে গির্জা আকার দিয়ে নাম দিল মঠ। সুদূর পর্তুগালের ‘মঠ’ কেমন জড়িয়ে রয়ে গেল বাংলার দোলের সংস্কৃতির সঙ্গে।
নগর কলকাতায় কুলদেবতাকে কেন্দ্র করেই খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দোল উৎসব পালন হত বনেদি বাড়িগুলিতে। পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের সিন্নি, হরির লুঠ এবং এলাহি খানাপিনার আয়োজন থাকত ।
প্রখ্যাত কলকাতা গবেষক ডঃ অতুল সুরের মতে তখনকার লোক কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই বলত ‘ওদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয়’। তার মানে, দোলযাত্রা দুর্গোৎসবের মতই একটা বড় উৎসব ছিল। এর সমর্থন পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে। অন্যান্য পরবে সরকারি আপিস যেখানে দু-একদিন বন্ধ থাকত, দুর্গোৎসবে আটদিন ও দোলযাত্রায় বন্ধ থাকত পাঁচদিন। প্রতিপদের ভোরে মহা সমারোহে পালন করা হত দেবদোল। দেবতাকে আবির দিয়ে তবেই পরিবারের সকলে দোল খেলবে। এরপর বেলা বাড়তেই শুরু হত রঙ খেলা। কীর্তনের আসর বসত দোলের দিন সন্ধ্যাবেলা।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবংশ ব্রাহ্ম ধর্ম নিলেও তাঁদের বাড়িতে দোলের আয়োজন ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। কলকাতা গবেষকের কথায় ‘বেশ সমারোহের সঙ্গেই দোল উৎসব হত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম হয়ে গেলেও ঠাকুরবাড়ির দোলে বেশ মাতামাতি হত।’ রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির দোল সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘দোলপূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা । দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।’
দোলের দিন কলকাতায় রঙ খেলার ট্র্যাডিশান বহুদিনের। পুরনো কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারিবাড়ি আর তাদের কুল দেবতা শ্যামরায়ের মন্দির ছিল লালদিঘি তে। কেউ বলে একবার দোলের সময় রং খেলায় এই পুকুরের জল এতই লাল হয়ে যায় যে নাম হয় লালদিঘি। শোভাবাজার দেবপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে রাজকৃষ্ণের পরিবারের গৃহদেবতা ‘গোপীনাথ জিউ’ এবং দত্তকপুত্র গোপীমোহনের পরিবারের গৃহদেবতা ‘গোবিন্দ জিউ’-কে ঘিরেই এই দুই শরিকের দোল-উত্সব আবর্তিত হয়। তবে ভিন্ন দিনে।
মহামিলনের জন্যই বুঝি এমন ঢালাও আয়োজন চলে আসছে হিন্দুধর্মে। নয়ত ফাল্গুনে দোলযাত্রার মত উৎসব মণ্ডিত যাত্রা পালনে সামিল হন কেন হাজার হাজার মানুষ? রাধাকৃষ্ণ তো প্রতীক মাত্র । সারা ভারতবর্ষে তিথিক্ষণ মেনে কেন আমরা এখনো জমায়েত হই বসন্তোৎসব প্রাঙ্গণের দোলতলায়? কেনই বা সুগন্ধি মুঠোমুঠো ফাগ আবীরে রাঙিয়ে দিই বন্ধুর মুখ? আর কেনই বা রঙ দিয়ে মিষ্টিমুখ করায় আমার বন্ধু? রাধাকৃষ্ণ, ঝুলন সাজানো, এসব তো মানুষের মনগড়া । আসল তো মাঝেমাঝে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটাকে ঝালিয়ে নেওয়া।
কৃষ্ণ স্বয়ং সেকথাও হয়ত বুঝেছিলেন। হঠাত হঠাত মথুরা থেকে বৃন্দাবন, সেখান থেকে দ্বারকা …তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ব্যস্তসমস্ত কর্মসূচীর টানাপোড়েনে শ্রীরাধার সঙ্গে সম্পর্কটা যায় যায় হয়ে দাঁড়াতো। তাই তো এই উতসবের মধ্যে দিয়ে আবারো মধুর সম্পর্কটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্ট করে যাওয়া। একান্তে দিনকয়েক কাছের করে পাওয়া। দুজনের কত শৃঙ্গার, ভৃঙ্গারে গল্পমুখর দিনরাত এক হয়ে যাওয়া। রঙ খেলা তো আসলে অজুহাত। তাই নয় কি? ঋতুবৈচিত্রের ওঠাপড়ায় মন ভালো করে দেওয়া আর সর্বোপরি মানভঞ্জন করে একটা জম্পেশ পার্টি অর্গানাইজ করা। দেব ভি খুশ অর দেবী ভি!
আমাদের ধর্মে অনেকরকমের যাত্রা রয়েছে। স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রা আর দোলযাত্রা। বৈষ্ণবমতে ফাল্গুণী পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা, শ্রাবণী পূর্ণিমায় ঝুলনযাত্রা আর কার্তিক পূর্ণিমায় রাসযাত্রা। সম্ভবতঃ শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রায় দোলনায় দোলা দেওয়া থেকেই দোলের নামকরণ। দোল বা হিন্দোলনের অর্থ হল সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনময় মানুষের জীবনে একচিলতে আনন্দ খুঁজে নেওয়া। পেন্ডুলামের মত চলমানতায় ভরা আমাদের জীবনে একবার দুঃখ আবার তারপরেই সুখ। কখনও বিরহ, কখনও মিলন। কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ। স্থির হয়ে থাকাটা জীবন নয়। এই দোলনার আসা ও যাওয়াটি রূপকমাত্র। তাই জন্যেই তো বলে “চক্রবত পরিবর্ততে সুখানি চ দুখানি চ।’
©️শঙ্খচিল
চিত্র সৌজন্য : গুগল