ঠিক যেখানে এসে আবছা হয়ে আসে সব শহুরে কোলাহল, গাঢ় হয়ে আসে বুনোফুলের গন্ধ, তারাবোনা রাত মায়াবী চাঁদোয়া বিছিয়ে দেয় চন্দ্রহীন আকাশ জুড়ে, রাতপাখি ডেকে যায় একঘেয়ে বিচিত্রস্বরে – ঠিক সেখান থেকে হাতগোনা দূরে শুরু হয় এক আদিগন্ত, নিবিড় বনভূমি।
রাস্তাধোয়া ঝরনা মাড়িয়ে, শুকনো পাতায় শব্দ তুলে, চুপসায়র পেরিয়ে, একদিন সেখানে ঢুকে পড়েছিলাম সাহস করে। হঠাৎ দেখি, অনেক বুড়ো গাছের ভিড়ে এলিয়ে আছে ভাঙা, নামমাত্র বাগানঘেরা একটা দেড়তলা বাড়ি। যার জংধরা জানলাগ্রিলে জড়িয়ে আছে লতানে বুনোগাছ, ধ্বসে গেছে গেটের থাম, পাঁচিল ভেঙে জঙ্গল মিশে গেছে কবেকার সজ্জিত বাগানে। সেখানে যে বহুদিন কেউ থাকেনা তা আর বলে দিতে হয়না। মর্চেধরা বিরাট তালাটা আলগা চাপে খুলে গেল, ঢুকে পড়লাম কাদের যেন ফেলে যাওয়া অন্দরমহলে। দেখি, আলগোছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কত আসবাব, বাসনপত্র, জামাকাপড় – ধুলোকিচকিচে, সুতো উঠে আসা – তবু যেন মনে হয় এ বাড়ির লোকেরা ভেবেছিল ফিরে আসবে একদিন। পাখির খাঁচা আছে প্রকান্ড, লম্বা সবুজ পালক পড়ে আছে কয়েকটা। রংচটা, তবু বোঝা যায় দিব্যি। পরপর সাজানো ঘর আছে বেশকটা। জানলার ভাঙা কাঁচ দিয়ে কোথাকার একটা ফিকে আলো এসে আলগা ছড়িয়ে আছে মেঝেভর্তি ধুলো, টুকরো পাতার ওপর, আলতো হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশ।
এ সবই দেখছি নিবিড়মনে, হঠাৎ-ই মনে হলো পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ বা কারা। চমকে পেছনে ফিরতেই পালালো ওরা। ছুটলাম শব্দ ধাওয়া করে। গাঢ় আঁধারে দেখা যাচ্ছেনা কাউকে। কোথাও একটা এসে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে আমি ঠাওর করতে পারিনা ভালো, তবু বুঝতে পারি ওরা পালিয়েছে সিমেন্ট খসা, ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে। হাতড়ে হাতড়ে উঠতে থাকি আমিও। একটা বাঁক ঘোরার পরই কেমন পাল্টে যায় অনুভূতি – মনে হয় এ কোনো খুব চেনা জায়গা। চোখ বেঁধে দিলেও আমি এগোতে পারবো ঠিক। এ কোথায় এলাম আমি? আমার পা যেন এই সিঁড়ি চেনে, জানে সব চৌকাঠের মাপ, মেঝের লাল-সিমেন্টের বর্ডার-দূরত্ব। ভূতগ্রস্থের মতো উঠতে থাকি আমি। ঠিক যেমন ভেবেছিলাম সেভাবেই পৌঁছে যাই ওপরের ঘরে। জায়গামতো হাতে পাই দরজা – যার ওপরভাগের নকশা করা গ্রিলে রঙিন কাঁচ লাগানো হয়নি কোনোদিন। আজ হাত লাগতেই খসে পড়ে গুঁড়ো কাঠ।
আশ্চর্য! ঘরের দরজা ঠেলে খুলতেই জ্বলে ওঠে একটা স্বপ্নরঙা আলো। এবার পরিস্কার দেখা যায় সব, যা আমি আগে কোথাও দেখেছি হাজারবার – হুবহু! ওই তো সেই প্রকান্ড লোহার খাট, অনেক বিনিদ্র রাতের আদর-আশ্রয়; ওই তো সেই পড়ার টেবিল, যেখানে বসে পর্দা ওড়া দেখেছি দুপুর-ভোর, নিষিদ্ধ বই গিলেছি মোটা টেক্সটবুকের ভাঁজে। ওই তো সেই পাড়ার দোকানে জমানো টাকায় বানানো মিউজিক সিস্টেম, অঝোর বৃষ্টিরাতে যা শুনিয়েছে মনখারাপের হাজোরো গান। ওই তো সেই ছোট্ট হাতলভাঙা আলমারি, যা বুকে করে রেখেছে কত ঝলমলে জলছবি, জুতোর বাক্স ভর্তি জমানো ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড ছেঁচে বার করা সস্তা স্ট্যাম্প, স্কুলব্যাগ করে লুকিয়ে আনা কারেন্ট নুনের প্যাকেট, ছেঁড়ামলাটের অরণ্যদেবের বই, রোভার্সের রয়-এর কাটিং, সংখ্যা মিলিয়ে রাখা নন্টে ফন্টের কান্ডকারখানা…। এগিয়ে যাই একটু — ওই তো সেই ঘরের সাথে লাগানো চানঘর, যার বিরাট খোলা জানলা দিয়ে সকালবেলার ওথলানো আলোর সাথেই উড়ে আসত কাছের চিনেমাটির কারখানার চিমনি থেকে বেরোনো কয়লা গুঁড়ো। রাতে যে জানলা বন্ধ করে দিতাম চোখ বন্ধ করে, পাছে না ছোখে পড়ে পাশের বাড়ির সদ্য মৃত জেঠুর প্রেতাত্মা। এই চানঘরেই গুমোট গরমে, মেয়ানো আলোয় চিনেছি নিজের শরীর, পড়েছি প্রথম প্রেমচিঠি, বেসিনের খোলা কল কতবার ধুয়ে দিয়েছে প্রতাখ্যাত হওয়া চোখের জল। আজ সব ধুলোধুসর, বিবর্ণ, ভেঙেপড়া — তবু চিনতে অসুবিধে হয়না, বুঝতে কষ্ট হয়না, এ ঘর-দ্বার আমার অনেক চেনা আর জানা।
কখন যেন ভুলে গেলাম সেই পায়ের আওয়াজের কথা। টেবিল থেকে তুলে নিলাম একটা ঝুরঝুরে পাতার বই। আমি ঠিক জানি এর তেত্রিশের পাতায় রাখা আছে একটা শিরা-বার-করা শুকনো গাছের পাতা, যেটা আমি কোনো এক শীতের দুপুরে গুঁজে দিয়েছিলাম বাগানের দক্ষিন দিকের ইউক্যালিপ্টাস গাছের থেকে তুলে এনে। এখন আর এ বই-এর নাম পড়া যায়না — তবু এ বই-ই পড়ব আমি আজ রাতভোর। আগেকার অভ্যাসমত লাফিয়ে উঠি বিছানায়, তোষকের ধুলো হাওয়ায় ধোঁয়া ওড়ায়। জানিনা কোথা থেকে যেন ঝুপ করে নেমে আসে একটা নীলচে মশারি। জমিয়ে বসি আমি। যে বই-এর এক বর্ণ পড়া যায় না, তার পাতা ওলটাতে ওলটাতে তন্দ্রা আসে আমার। চোখ রগড়ে নিই। আজ সারারাত জাগবো আমি। আবার কখন ঘুমিয়েও পড়ি গভীর।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায় কেন যেন। বুঝতে পারি বৃষ্টি হয়ে গেছে এক-পশলা। পূবদিকের জানলা দিয়ে ভেসে আসছে ছাতিমের তীব্র গন্ধ মেশানো ভিজে হাওয়া। রাতজাগা পাখিদের সুরের সাথে মীড়ে ঝলছে ঝিঁঝিঁদের দল। হঠাৎ আবার পায়ের আওয়াজ। অন্ধকারে সয়ে যাওয়া চোখে, আবছা আলোয় চেয়ে দেখি দরজার কাছে একটা বাচ্ছা ছেলে আর তার পায়ের কাছে একটা লোমশ কুকুর — একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কুকুরটা ঘরে ঢুকতে চায়, ছেলেটা আটকায়। তারপর ছেড়েও দেয় একসময়। কুকুরটা এগিয়ে আসে আমার দিকে, সামনের দু’পা তুলে দেয় খাটে, শুঁকতে থাকে আর ল্যাজ নাড়তে থাকে। তবে, আমি কি ওদের চেনা? আমি তো কি চিনতে পারছি না ওদের।
এবার মশারি ছেড়ে বেরোই আমি। ছেলেটা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে। আমি এগোই ওর দিকে। জিগ্যেস করি – ‘কারা তোমরা?’ ছেলে উত্তর দেয়না। কুকুরটাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাইরের দিকে। আমি যাই ওদের পেছনে। ওদের সাথেই বেরিয়ে আসি বিরাট খোলা ছাদে। ওপরে তাকিয়ে দেখি কাঁচের মতো আকাশে ফুটে আছে থোকা থোকা তারা, ছায়াপথ চলে গেছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, চরাচর ভেসে যাচ্ছে নক্ষত্র-আলোকে। হঠাৎ একটা রিনরিনে গলা কানে আসে। ছেলেটা কথা বলছে – ‘ওইটা কি চিনতে পারো?’ সে আঙুল দেখাচ্ছে চিলেকোঠার ছাদের ওপর একটা লম্বা লাঠির মাথায় বসানো নরম, লালরঙের আলোর দিকে। আমি নিরুত্তর। ছেলে বলে — ‘ওই আলো দেখেই আমি নেমে এসেছি আমার বন্ধুকে সঙ্গে করে। এখানেই থাকতাম আমরা। দেদার মজা করতাম। তারপর যেদিন তুমি হঠাৎ বড় হয়ে গেলে, আমি গেলাম মরে। তবু আজও এই বাড়ি টানে আমাদের। ওই আলোর নিশানা দেখে আমরা নেমে আসি পুরনো জায়গায়। ঘুরে বেড়ায় পুরনো টানে।’ বলে পেছন ফেরে সে। অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে থাকে। আমি চেঁচাই জঙ্গল কাঁপিয়ে – ‘কে তুমি?’ রিনরিনে গলা জবাব দেয় — ‘আমি তোমার মৃত অতীত, তোমার ছেলেবেলা।’
চারদিকে এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা। ছাদে সটান শুয়ে পড়ি আমি। কার্তিক মাসের হিম কুয়াশা নামে আমার শরীর জুড়ে। শীত করে আমার। অসাড় শরীরে, মরা মাছের মতো চোখ মেলে পড়ে থাকি আমি। চিলছাদে, অনন্ত মহাকাশে মুখ তুলে জ্বলতে থাকে আকাশপ্রদীপ।
ওরা ফেরেনি। আমিও আর ডাকিনি ওদের।