পুজোর একাল সেকাল

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
3955 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ


শরৎ এলেই উৎসবের গন্ধে বিভোর থাকে বাঙালি হিন্দুদের মন। পুজোর আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে এ প্রাণ থেকে ও প্রাণে। ধর্ম-বর্ণের জাল ভেদ করে সর্বোপরি দুর্গাপূজা রূপ নেয় বাঙালির উৎসবে। হালের পূজা আয়োজনে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। পরিবর্তনের এ হাওয়াটা কেমন_ তা জানতে প্রিয় চট্টগ্রাম গিয়েছিল বিশিষ্টজনদের কাছে। বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিপ্লব শীল দুর্গাপূজা বাঙালির সর্বজনীন পূজা_প্রফেসর ড. অনুপম সেনবিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও উপাচার্য, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিদুর্গাপূজা বাঙালির সর্বজনীন পূজা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যই এই পূজার দ্বার উন্মুক্ত। সবারই আহ্বান আছে, সবারই আমন্ত্রণ আছে এ পুজোয়। শরৎকালে এ পুজো হয়, যখন গ্রীষ্মের তাপদাহ ও বর্ষার বর্ষণের প্রকোপ কমে; যখন আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি থাকে; তখনই বাঙালি হিন্দু এ পুজোয় মেতে ওঠে।

বাংলাদেশের বাইরে ভারতের অন্যান্য জায়গায় দশমী বা দশেরা উৎসব হলেও দুর্গাপূজা এভাবে হয় না। দুর্গাপূজার সঙ্গে বাঙালি বধূর বাপের বাড়িতে ফেরার একটা ব্যাপার জড়িয়ে আছে। মা দুর্গা চার দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসেন। আবার দশমীর দিন ফিরে যান পিত্রালয় ছেড়ে। বাঙালি বধূরা যেভাবে এ পুজোয় মেতে ওঠে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু বধূ বা মেয়েরা সেভাবে পুজোটি উদযাপন করে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাই দুর্গাপূজার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলিক আচার-আচরণ জড়িয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি দুর্গাপূজার সময় আমার মুসলমান ও বৌদ্ধ বন্ধুদের পুজোর আনন্দে অংশ নিতে। বিভিন্ন মণ্ডপে সপ্তমী থেকেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে হিন্দু শিল্পীদের সঙ্গে অংশ নিতেন মুসলমান শিল্পীরাও। ঈদে যেমন সবাই অংশ নেয়, সে রকম পুজোর অনুষ্ঠানেও সব বাঙালি অংশ নেয়। এ আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ রয়েছে।

মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকেই সর্বজনীন রূপ নিয়েছে দুর্গাপূজা। আগে আরতিতে যে আকুতি ছিল, এখন তা নেই _রণজিৎ রক্ষিতআবৃত্তিকার ও অভিনেতাআমার বাসায় একটি শিউলি ফুলের গাছ ছিল। তাই শহরে বসে কাশফুল না দেখলেও ভোরের ঢাকের আওয়াজ এবং শিউলি ফুলের সুবাসিত ঘ্রাণ এবং স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে প্যান্ডেলে যাওয়ার একটি সুখস্বপ্ন দেখতাম। তখনকার প্রতিমা ও পূজাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। সন্ধ্যায় আরতির মাধ্যমে মায়ের চরণে সমর্পণের যে আকুতি ছিল তা পর্যবেক্ষণের জন্য দর্শনার্থীদের মধ্যে একটি আবেগ কাজ করত। এখন দর্শনার্থীরা পূজাঙ্গনে যায় আলোর বাহার দেখতে, মাইকের শব্দ শুনতে এবং মিউজিক সিস্টেমের তালে গা দোলাতে। যদিও একে অনেকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ দাবি করে কিন্তু এ বিকট শব্দদূষণ আমাকে কোনো আনন্দ দেয় না। তার চেয়ে আমি সময়টাতে ভ্রমণ এবং শারদীয়া উপলক্ষে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলোর পাতা ওল্টাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর্থিক সমস্যার কারণে এখন পারিবারিক পূজাগুলোর ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারগুলোর ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় গ্রাম বাংলায় এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এখনকার পূজার আনন্দের সঙ্গে আর্থিক সামর্থ্য জড়িয়ে আছে। কিন্তু যৌথ পরিবারগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় পূজার আনন্দে সমষ্টিগত আবেগ দেখা যায় না। আসুন, আমরা প্রতিটি এলাকার পূজার আয়োজন থেকে ওই এলাকার নগরীর জনসাধারণকে মানবিক সাহায্য, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং এলাকায় সাংস্কৃতিক চেতনাকে বিকাশের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের পরিকল্পনা করি। এ হোক আমাদের মনের পশু বিনাশে মায়ের প্রতি প্রতিজ্ঞার অঞ্জলি।

এখন পূজা গৌণ, সাজটা মুখ্য_শক্তিনাথানন্দ মহারাজঅধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মিশন, চট্টগ্রামপূজা তো পূজার মতো হতো। কিন্তু আমাদের গ্রামে বিশেষত্ব ছিল বলিতে। তিন দিনই পশু বলি দেওয়া হতো। আকর্ষণ ছিল পূজার প্রসাদ বিতরণ, আরতি ও বলি অনুষ্ঠান আয়োজনে। তখন প্রসাদ দেওয়া হতো মাটির সরাইয়ে। নতুন জামাকাপড় ছিল একটাই। তখন নতুন জামা পাচ্ছি এটাই বড় কথা ছিল। এখন তো প্রায় সবাই বাহারি জামাকাপড় পরছেন। আগে পূজার মধ্যে ডেকোরেশন ছিল কিন্তু মাইকের উৎপাত ছিল না। তখন হ্যাজাক বাতিতে পূজামণ্ডপ আলো করে রাখা হতো। তবে পূজার আগ মুহূর্ত যেখানে প্রতিমা বানানো হতো সেখানে গিয়ে আমরা বারবার দেখতাম কতটুকু রঙ হয়েছে। প্রতিমার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হতো তুলির রঙে। এখন তো স্প্রে করা হয়। তখন মৃৎশিল্পীরা নারিকেলের মালায় পাউডার-রঙ-পানি দিয়ে গুলতেন। পরে সেই রঙ প্রতিমার গায়ে লাগানো হতো। গ্গ্নসি রঙ করতে একটু বার্নিশও করা হতো। তখন বাহ্যিক আড়ম্বর এত বেশি ছিল না, আনন্দ হতো, যাত্রা হতো; নাটক হতো। এ জন্য পূজার এক মাস আগ থেকেই রিহার্সেল চলত। তখন প্রতিমাগুলো এক কাঠামোতে হতো; এখন প্রতিমাগুলো ভগ্ন ঘরের ন্যায় আলাদাভাবে বসানো হয়। এখানে পূজাটা গৌণ, সাজটা মুখ্য। এটা বেশিরভাগ হয়েছে পারিবারিক পূজা না থাকায়। আগে মানুষের আনন্দে পরিমিতিবোধ ছিল, এখন ছেলেমেয়েরা এভাবেই আনন্দ করতে চায়। তখন ধূপতির সঙ্গে রকমারিভাবে আরতির মধ্যে একটা জৌলুস ছিল, এখন তা দেখা যায় না। আমরা প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাসায় আসার পর সবাই মিলে কাদা ছোড়াছুড়ি করতাম_ সত্যিই এক নির্মল আনন্দ। চণ্ডী পাঠের আনন্দটাই ছিল অন্যরকম_প্রফেসর ড. প্রকৃতি ভট্টাচার্য অধ্যক্ষ, পাথরঘাটা মহিলা মহাবিদ্যালয়আমাদের ছোটবেলার পুজোয় একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। সেটা হচ্ছে চণ্ডী পাঠ। আমার বাবার চণ্ডী পাঠ ছিল অসাধারণ। চণ্ডী পাঠ গ্রামে জাগরণ বা পুঁথি নামে পরিচিত। দশমীর দিন এটি শেষ করতে হয়। লাচাড়ী ও পয়ার ছন্দে এগুলো পড়া হতো। আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে পড়তাম। এ জন্য দুর্গাপূজা ছিল খুব আনন্দের। প্রায় মাস খানেক আগে থেকেই যখনই খড়ের বেনাটা বাঁধছে তখন থেকেই আমাদের আনন্দ শুরু হয়ে যেত। প্রতিদিন দেখা, প্রতিমার কীভাবে কী হচ্ছে, কতখানি এগোচ্ছে কাজ।

আমাদের গ্রামে কয়েকটি পুজো হতো। পুজোগুলোতে সারা গ্রাম মিলে তখন এমন একটা পরিবেশ হতো, যেন পুজো নয় এটা সারা গ্রামের আনন্দ। ভোরের কুয়াশা, শীত শীত ভাব যেন জানান দিত পূজা এসে গেছে। মহালয়া যেদিন সেদিন তো আর কথাই নেই। পুজোয় দিনভর ঘুরলেও সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হতো। আমার মনে হয় আমাদের ছেলেবেলার যে আনন্দ ছিল এখনকার শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত। তখন মণ্ডপে মণ্ডপে হ্যাজাক বাতি জ্বলত। সারা গ্রাম অন্ধকার, কিন্তু যেখানে পুজো ওখানে আলোর বন্যা। এটা আমাদের ভীষণ আনন্দ দিত। তিন-চার দিন ধরে হৈচৈ, কিন্তু দশমীর দিনে মন খারাপ হয়ে যেত। দশমীর দিন সন্ধ্যার পর থেকেই চারপাশ নিঝুম। আবারও আগের মতো গ্রাম, আগের মতো জীবন। পুজোর পর কয়েকদিন মন খারাপ থাকত। হালে হুল্লোড় আছেনির্মল আনন্দ নেই_অরুণ দাশগুপ্তকবি ও সাহিত্যিক, সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আজাদীপুজোয় আনন্দ ছিল, উল্লোল ছিল। আমাদের বাড়িতেও পুজো হতো। গ্রামে যাদের বাড়িতে পুজা হতো তাদের এক মাস আগে থেকেই পূজার আনন্দ শুরু হতো। আমাদেরও তা-ই হয়েছে। ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন থাকত। প্রতিমা যেখানে খড়-মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো সেখানে আমরা প্রতিদিনই বারবার দেখতে যেতাম। প্রতিমাতে খড় আজ কতটুক লাগানো হয়েছে, মাটি কতটুকু লাগছে_ এভাবে দেখতে আমাদের আনন্দের কমতি ছিল না। তখন জাঁকজমকভাবে ধূপতি দিয়ে নানা সাজের আলাদা পোশাকে আরতি হতো।

তখন মহালয়া মানে স্কুলের ছুটি। আজকে যে শান-শওকত তখনকার দিনে শুধু পূজাঙ্গনের জন্যই খরচ হতো। কালে কালে ঋতু বদলায়, কালে কালে মানুষের রুচি বদলায়। এখন পুজোর সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি হুল্লোড়ও বেড়েছে। কিন্তু কোথাও যেন নির্মল আনন্দ নেই। তখন দুর্গাপূজা হলে যাত্রা, এটা-সেটা করা হতো, গান বাজনা হতো, কমিক হতো; এখন এর কিছুই নেই। এখন গানের নামে হচ্ছে চিৎকার, যা আপনার স্নায়ুকে করছে উত্তেজিত। তখন লোকসংখ্যা কম ছিল, মানুষের মধ্যে আনন্দও ছিল।সচ্ছল গেরস্তদের ঘরে ঘরে দুর্গাপূজা হতো। আমার মাসতুতো মামা তো কয়েকদিন আগে বললো, আমার ছোটবেলার আর কিছু মনে না থাকলেও তোমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজার আনন্দের কথা এখনও মনে আছে। পুজোয় সবাই খুব আনন্দ করত, আর বিসর্জনের সময় সবার মন বিষণ্ন থাকত। ওইদিন বধূদের চোখ দিয়ে জল পড়ত, ফুঁফিয়ে কান্না করত। তারা মাকে পান-সিঁদুর মেখে বিদায় জানাতেন। সেই যে আবেগ এখন আর দেখাই যায় না। দুর্গাপূজা বরাবরই আনন্দের। এখন শাস্ত্রের দিকে পূজা উদযাপনে পরিবর্তন বা একটু ঘাটতি হলেও তেমন বড় কিছু হয়নি। তবে মানুষকে নির্মল আনন্দ দিতে পারলে ভালো হতো। আগের সঙ্গে এখন অনেক তফাৎ থাকলেও দুর্গা কিন্তু প্রতিবছরই ঘরের কন্যার মতো বাপের বাড়ি আসছে। তাকে নিয়ে মহানন্দে বাঙালি সমাজ মেতে ওঠার মধ্য দিয়ে পূজা করছে। বর্তমানে পূজামণ্ডপে শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়_প্রফেসর রীতা দত্ত সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজবর্তমানে পূজামণ্ডপে বিভিন্ন থিম লক্ষ্য করছি, এটা প্রশংসনীয়। কারণ এই থিমগুলো ঘিরে আমরা যে শিল্পী মনের পরিচয় পাই সেগুলো দৃষ্টিনন্দন তো বটেই, আমাদের মধ্যে একটা নান্দনিক অনুভূতি সৃষ্টি করে। এ জন্য এখনকার পূজা আগের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য। আমি বলতে চাইছি, পূজায় তো একটা আধ্যাত্মিক দিক থাকেই, কিন্তু সে আধ্যাত্মিকতাটা ছাপিয়ে শিল্পী মনের যে সৌন্দর্য প্রকাশিত হচ্ছে এটা কিন্তু কম প্রশংসনীয় নয়। তবে এখন পুজোকে ঘিরে যে আনন্দ-উৎসব তা একটু ভিন্ন গতিতে চলে গেছে। আগে পুজো ঘিরে যে নির্মল আনন্দ ছিল এখন তা নেই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব পূজা-পার্বণ নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি না করে আধ্যাত্মিকতার দিকে চলে গেলেই ভালো। কারণ তারুণ্যের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার জন্য তো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে।
©️শঙ্খচিল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল