গুণমুগ্ধ এই পাঠিকাকে স্বভাবসুলভ গুণেই আপন করে নিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।রবীন্দ্রজীবনে প্রেম অধ্যায়ে পাওয়া যায় তাঁর আরও একজন প্রণয়ীকে, যার নাম হেমন্তবালা রায়চৌধুরী। হেমন্তবালা ছিলেন রবীন্দ্র রচনার গুণমুগ্ধ পাঠিকা। দুজনের মধ্যে আলাপ হতো পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে। তাঁর সঙ্গে কবির একাধিক পত্র বিনিময় হয়েছে। কবিকে হেমন্তবালা ডাকতেন, “কবিদাদা”। নানা অজুহাতে, পারিবারিক বাধা সত্ত্বেও, এমনকি রাতের বেলায়ও ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে হঠাৎ গিয়ে হাজির হতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে হেমন্তবালা লেখেন, “আপনি আমার দেবতা, আমার কল্পলোকের রাজা। আমার পূর্ণ পূজা আপনার চরণে দিতে দিতে পারছি না। আপনি কি আমার মন দেখতে পারছেন না…??”
কৈশোরের স্থপতি কাদম্বরী বৌঠানের অকালে চলে যাওয়ার স্মৃতি রবীন্দ্রনাথকে যৌবনেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল। কিছুটা হয়তো ভুলতে পেরেছিলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার সৌজন্যে। ইন্দিরা বয়সে ছোটো হলেও মনের দিক থেকে এই মেয়েটির সাথে কবির অন্তরাত্মার যে অনেক বোঝাপড়াই হয়েছিল, তা ইন্দিরাকে লেখা বেশ কিছু চিঠি পড়ে বোঝা যায়। পশ্চিমি আদবকায়দায় রপ্ত ঠাকুর বাড়ির এই কন্যেটি রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থানাধিকারিণী “পদ্মাবতী স্বর্ণপদক” প্রাপ্তা ইন্দিরা বহুদিন পর্যন্ত অনূঢ়া ছিলেন। যেমন সঙ্গীতচর্চায় আগ্রহী, তেমনি সাহিত্যের অনুরাগী। তাঁর ‘রবিকা’র (রবীন্দ্রনাথকে তিনি ওই নামেই ডাকতেন) লেখা কবিতার তিনি ছিলেন অন্তরঙ্গ পাঠক। এতো রূপসী আর গুণবতী ইন্দিরা বিয়েই করতে চাননি। বিয়ের বাজারে সেই সময় এই পাত্রীর দাম অনেক। তবুও পাত্রী বিয়ের কথা ভাবলেই অজানা আশঙ্কায় ভীত। সে তাঁর রবিকা কে ছেড়ে থাকতে পারবে তো…!! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো এমনটাই লিখেছিলেন তাঁর উপন্যাস “প্রথম আলো”তে… “কুড়ি বছর বয়স হয়ে গেলো, এখনো সে বিবাহে অনিচ্ছুক, এ কেমন কথা…!! কিসের জন্য যে তাঁর আপত্তি তা সে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলতেও পারে না কাউকে। তবে কি সে রবিকা কে ছেড়ে থাকতে চায় না…?? একেবারে শিশুবয়স থেকেই সে রবিকাকার ন্যাওটা। তাঁদের দুজনের সম্পর্কটা এমন একটা নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছিল যে কেউ কাউকে ছেড়ে সত্যিই থাকতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথের মতো অমন পুরুষশ্রেষ্ঠ, অমন প্রতিভাবান, অমন সহৃদয় মানুষকে এতো কাছাকাছি পেয়েছে ইন্দিরা, অন্য কোন পুরুষকে তাঁর পছন্দ হবে কেন?? রবীন্দ্রনাথ যখন বাইরে কোথাও যেতেন, তখন সেখানে থাকাকালীনও ইন্দিরা তাঁকে প্রতিদিন একটি বা দুটি পত্র লিখতেন। আর রবীন্দ্রনাথও সেই চিঠির দীর্ঘ উত্তর দিতেন। এমনকি অন্য সব কাজ ফেলেও তাঁর আগে ইন্দিরার চিঠির উত্তর দেওয়া চাই-ই। “
প্রায় চব্বিশ বছর অবধি আইবুড়ো থেকে ইন্দিরা ঠাকুর পরিবারে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। কাকা রবীন্দ্রের সাথে তাঁর এই বিশেষ সম্পর্কের কথা কেউ জানতে চাইলে তিনি বলতেন- “কিসের আবার? বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের..!!”
বহুদিনের অদর্শনে যখন ইন্দিরার প্রাণ হাঁকপাঁক করেছে, তখন মান-অভিমানের পালা চলছে দুজনের মধ্যে। আবার দেখা হতেই সেই রাগ অনুরাগে পরিণত হয়েছে। একবার ‘রবিকা’র জন্য অপেক্ষায় ফ্যাকাসে হয়েছে ইন্দিরার মুখ। গাড়ি থেকে নামতে নামতে হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে সারা কবি। সরলা আর ইন্দিরার উতসুক হয়ে দরজায় দাঁড়ানো দেখে, কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেছেন ইন্দিরাকে। বলে উঠেছেন, “বি, বি, দুটো মৌমাছি।”
কে জানে, হয়তো নিজের সহজ সঙ্গিনী মৃণালিনীর কাব্যচর্চায় অনুৎসাহ বা কবির সাথে মনের আদানপ্রদান নিতান্ত কম ছিল বলেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের ফ্যানক্লাব খুলেছিলেন, যার অন্যতম সদস্যা ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী।
মৃণালিনী দেবী তাঁকে শরীর সুখ থেকে হয়তো বঞ্চিত করেননি, কিন্তু আর কি কিছু দিতে পেরেছিলেন..?? আর তাই বুঝি কবি শিলাইদহের পদ্মার বোটে ভাসমান হয়ে, অথবা দার্জিলিঙের পাহাড়ে, কিংবা লন্ডনে বসে চিঠি লিখেছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে। মৃণালিনী আর ইন্দিরা কিন্তু প্রায় সমবয়সী, কিন্তু ইন্দিরার প্রতি তাঁর কি গভীর অনুরাগ আর স্পৃহা, আর মৃণালিনীর প্রতি কি অনীহা …!! তাই বুঝি ইন্দিরাকে লিখতে পেরেছিলেন — “আমরা দৈবক্রমে প্রকাশ হই, আমরা ইচ্ছে করলে, চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারি নে, — চব্বিশ ঘন্টা যাদের সঙ্গে থাকি, তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত।” তাই মৃণালিনী হয়ে রইলেন আঁতুড়ঘরের আদরের উপবাসী হয়ে, আর ইন্দিরা হয়ে উঠলেন চিরন্তন শাশ্বতী নায়িকা…. ‘রবিকা’র সাথে বিচ্ছেদের কথা ভাবলেই এই অনূঢ়ার মন থেকে বিবাহের চিন্তা উধাও হয়।
বিলেতে গিয়ে গোছা গোছা উজানী চিঠি লিখেছেন কাকা তাঁর ভাইঝিকে। আর কবির সাহিত্যের স্বর্ণযুগে জোয়ার এসেছে ভীষণ প্রাবল্যে। এবং তা বুঝি কিছুটা সম্ভব হয়েছে ইন্দিরার আনুকূল্যে।
বয়সের প্রায় শেষ সীমায় এসে কবি নিজের ক্লান্ত, শোকাকুল জীবনের প্রণয়সরণী বেয়ে আরো অনেকটা পথ হাঁটলেন রাণু অধিকারীর সাথে। সারা জীবনের মনের খোরাক অজানা অভিসারী পথ বেয়ে কবির কাছে চলে আসে চিঠি হয়ে। উত্তর দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট প্রম্পট। হঠাৎ বারো বছরের এক বালিকার কাছ থেকে সুদূর বারাণসী থেকে উড়ে এলো এক চিঠি। পত্রদাতার নাম রাণু অধিকারী। সংস্কৃত অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারীর কন্যা। রাণু এর মধ্যেই এতো অল্প বয়সে পড়ে ফেলেছে কবির সব গল্প, আর চিঠিতে তার অনুযোগ কেন কবি ইদানীং এতো কম গল্প লিখছেন…!! কলকাতায় গিয়ে সেই একরত্তি মেয়ে প্রৌঢ় কবিকে দিয়েছে কিছুটা শান্তি। কন্যা মাধুরীলতাকেও (রেণু) কবি ওই নামে ডাকতেন কখনো কখনো। সেই মাধুরীলতার মৃত্যুতে ব্যথিত কবি ভাড়া করা গাড়ি করে ছুটে গেছেন রাণুদের কলকাতার ভবানীপুরের বাড়িতে…. শোক ভুলতে, হারানো মেয়েকে আবার নতুন করে পারেন বলে। জীবনের পড়ন্তবেলায় দাগ ফেলে দিয়ে গেছে সেই মেয়ে।
©️শঙ্খচিল
বিগত পর্বগুলোর লিঙ্ক:-
১.www.saabdik.com/kobi-katha-o-prem
২.www.saabdik.com/kobikotha_o_prem_part_2
৩.www.saabdik.com/kobikotha_o_prem_part_3
৪.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-4
৫.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-5৬.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-6
৭.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-7৮.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-8৯.www.saabdik.com/kobikotha-o-prem-part-9
[আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে,কখনো অজানা কে জানা কিংবা অচেনা চেনা মাধ্যমে.. অন্য কোথাও,অন্য পরিসরে আবার কবিচর্চা ফিরে ফিরে আসবেই..লেখকের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ এবং সহযোগিতার জন্য রইলো কৃতজ্ঞতা…লেখকের পুজো সিরিজ নিয়ে আমরা ফিরছি খুব তাড়াতাড়ি..অপেক্ষা মাত্র কিছুদিনের..]