মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো নারায়নের। দেশ নিয়ে,ধর্ম নিয়ে এই অপমান এই বিশ্রী হাসি ঠাট্টা বড় ব্যাথিত করে তাকে। সাধারন খেটে খাওয়া দিনমজুর সে। সেই ছোটবেলায় মাদ্রাজ থেকে কাজের জন্য বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলো আমেরিকায়। আজ ২৫ বছর হয়ে গেলো এখানে। আমেরিকায় কাজ আছে, অর্থও আছে।বিদ্যে বিশেষ নেই, তাই মুটে কুলির কাজ মিলেছে ঠিকাদারের কাছে। বন্দরে শহরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ। এখানেই সংসার করেছে। দেশে ফেরার কথা ভাবেনা আর। সব কিছু মিলিয়ে সুখেই আছে। কিন্তু কাঁটার মতো লাগে তার দেশ নিয়ে এই হাসি ঠাট্টা।
তাদের মজুর দলে আছে শ্বেতাঙ্গ ক্রিশ্চান,আছে তুর্কি মুসলিম,আর আছে নিগ্রো কালো মানুষের দল। তাদের মধ্যে প্রচুর তফাৎ, মিল শুধু এক জায়গায়, এই তার পিছনে লাগায়। ক্রমাগত তারা বলে ভারতীয়দের না আছে শ্বেতাঙ্গদের মতো বিদ্যা বুদ্ধি, আর না আছে নিগ্রোেদের মতো শক্তি। জনসন বলল তোরা হলি দোআঁশলা। কালোও না আবার সাদাও না।তোদের একটা কোন জাতি নেই শুনেছি। ভারতীয় নয়, তোরা বাঙালি বিহারী মারাঠি এইসব আলাদা জাতিতে বিভক্ত। ইউ আর টোটালি বাস্টার্ড নেশন। কখনো হয়ত ধাক্কা দিলো আচমকাই। তারপর তার শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে শুরু হোল হাসাহাসি। সত্যি সে নিগ্রো বা আমেরিকানদের থেকে দুর্বল অনেকটাই। তাদের মতো মাল বওয়া বা একটানা কাজ করার ক্ষমতা তার নেই। সবচেয়ে পাজি হোল সাদা কুলি গুলো। নিজেদের রাজা মহারাজা মনে করে। আফ্রিকানদের নিয়েও ব্যঙ্গ করে, কিন্তু বেশি সাহস পায়না। আফ্রিকানরা মারামারি শুরু করে দেয়। গায়ের জোরে ওদের সাথে পেরে ওঠেনা। তাই যত হাসি ঠাট্টা সব ভারতীয়দের নিয়ে। মুখ বুজে সহ্য করে নারায়ন। কী বা করার আছে আর। কাজ তো করতেই হবে। কিন্তু মনটা খারাপ লাগে মাঝে মাঝে।
এখন তাদের কাজ পরেছে শিকাগোতে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এক বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে কলম্বিয়ান এক্সপোজিশন। এখানে প্রচুর উৎসব আমোদ আহ্লাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে চেয়ার বওয়া, পরিষ্কার করা, আরও সব কাজের দায়িত্ব পেয়েছে তাদের মালিক। তাই এখন এখানে তারা। আর মেলার মুখ্য আকর্ষণ ধর্মমহাসভা।সেখানে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিও আসবে। আর সে কথা শুনেই শুরু হয়েছে ব্যঙ্গের ঝড়। তোদের কটা দেবতারে? সব ধর্মের একজন প্রতিষ্ঠাতা আছে। তোদের কে রে? হি হি হি ওই ধর্মের কোন পিতৃপরিচয় নেই। ধর্মও বাস্টার্ড। তোদের মানুষের থেকে দেবদেবী বেশি। শিক্ষা,যন্ত্র,আগুন, বৃষ্টি সবের আলাদা ডিপার্টমেন্ট, আর আলাদা ঈশ্বর, হো হো হো। তোদের ধর্মগ্রন্থও তো নেই রে। আজব ধর্ম। শুনেছি তোদের দেশে স্ত্রীদের পুড়িয়ে মারে, নদীতে সন্তান ভাসায়, এ ধর্ম না অধর্ম? তারপর দেবদেবীদের চেহারা নিয়ে শুরু হয় ঠাট্টা। কার চারহাত, কার তিন চোখ, কার হাতির মাথা, অল আর হ্যান্ডিক্যাপড।আর কালী মূর্তি নিয়ে যা বলে তা আর শোনা যায়না। নারায়ন মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকে। হে ঈশ্বর রক্ষা কর। এই অপমান থেকে বাঁচাও।
সেদিন ১১ই সেপ্টেম্বর। তাদের দায়িত্ব পড়েছে শিকাগো আর্ট ইন্সটিটিউটে ধর্মসভায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা শুনছে বক্তৃতা। খ্রিশ্চান যাজক শোনালেন প্রভু যিশুর বানী। প্রমান করতে চাইলেন তাঁদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ ও সুসভ্য। একে একে ইসলাম, জৈন, ইহুদি, পারসিক সবাই নিজেদের পক্ষে যুক্তি দিলেন। প্রত্যেকেই প্রমান করতে চায় তারাই সেরা। একদম শেষের দিকে ডাকা হোল ভারতের হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দকে। নাম ঘোষণা হতেই নারায়নের সঙ্গীদের মুখে খেলে গেলো মুচকি হাসি। এবার ভারতীয় ফকিরের পালা। তারাও প্রশ্ন করবে ওই চারহাত, পাঁচমাথা দেবদেবীদের চেহারা নিয়ে। কুসংস্কারের কথায় জর্জরিত করবে সন্ন্যাসীকে। ঘাবড়ে দেবে ওই নামগোত্রহীন ধর্মের প্রতিনিধিকে। যেমন নারায়নকে মজা করে, ওকে নিয়েও মজা করা যাবে বেশ।
মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন বিবেকানন্দ। এক আশ্চর্য জ্যোতি প্রকাশ পেলো তাঁর চোখে মুখে। শুরু করলেন তিনি,”আমেরিকাবাসি বোন ও ভাইয়েরা……।” হাততালিতে ফেটে পড়লো সভাগৃহ। এইভাবে হাজার মাইল দূরের মানুষদের ভাই বোন বলে ডাকা যায় ভাবতেই পারেননি তারা। ভাইয়ের আগে বোন সম্বোধন করে বুঝিয়ে দিলেন ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর স্থান সবার পূর্বে। এই করতালির বন্যায় ঘাবড়ে গেলো বন্ধুর দল, আর গর্বে বুক ভরে গেলো নারায়নের। আজ যেন নারায়নের সব অপমানের জবাব দিতে উঠেছেন স্বামীজি। তাঁকে নিয়ে তার ধর্ম নিয়ে যা যা ব্যঙ্গ হতো সেগুলিই বলছেন তিনি।…… হিন্দু ধর্মের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, কারন এটি শুধু একটি ধর্ম নয় এটি একটি সংস্কৃতি।বহু ঋষি পণ্ডিতের মিলিত অবদানে এর সৃষ্টি। তাই এ ধর্ম বিশ্বজনীন।সকল ধর্মের জননী বলে অভিহিত করলেন হিন্দু ধর্মকে। বেদান্ত হোল পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থের আকর। উদাহরন দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সব ধর্মগ্রন্থেই আছে বেদান্তের বানী। ব্যাখ্যা শুনে জনগন স্তব্ধ হয়ে গেলো।
তিনি বলতে লাগলেন, হিন্দু ধর্মের মুল কথা সহিষ্ণুতা। তাই প্রাচীন ইহুদি,পার্সি,মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই আশ্রয় পায় সনাতন আদর্শে বিশ্বাসী ভারতের বুকে। কি দৃপ্ত তাঁর বাচনভঙ্গি, কি অকাট্য তাঁর
যুক্তিজাল। একের পর এক বক্তৃতায় বলে চললেন তিনি, এক হিন্দু ধর্মের মধ্যেই আছে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, নায়নার, আলওার, দশনামী সম্প্রদায়।তাই বহুত্ববাদকে অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পারে হিন্দুরা। সব ধর্মকে আপন করতে জানে। বললেন কীভাবে মৃন্ময়ে প্রকাশিত হয় চিন্ময়ী। কোন সময়ে দেবদেবীর কি রূপে পূজা হয় ব্যাখা দিলেন তারও। গাছ বৃষ্টি মাটি সব আলাদা দেবতা যে আসলে প্রকৃতি পুজা, বুঝিয়ে দিলেন তাও। যেসব নিয়ে এতো হাসাহাসি তার যে এতো সুন্দর ব্যাখ্যা হতে পারে ভাবতে পারেননি কেউই। তিনি দেখিয়ে দিলেন ভারত কতোটা উন্নত তার প্রকাশ রয়েছে তার ধর্মেই। যেগুলি ছিল পরিহাসের বিষয় সেগুলি নারায়নের কাছে হয়ে উঠলো পরম গর্বের।আর ধর্মের সাথে বিজ্ঞান বিষয়েও বক্তব্য রাখতে হোল তাঁকে। সেখানে তুলে ধরলেন প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চেতনার ইতিহাস।
১৫ তারিখের বক্তৃতায় স্বামীজি শুরু করলেন কুয়োর ব্যাঙের গল্প দিয়ে।বুঝিয়ে দিলেন যারা অন্য ধর্মকে ছোট করে তারা আসলে ওই কুয়োর ব্যাঙের মতোই বদ্ধ। সে কাহিনী শুনে যখন সকল দেশের প্রতিনিধিরা ধন্য ধন্য করছেন নারায়নের তখন মুখে বিজয়ীর হাসি, চোখে আনন্দ অশ্রু। সব গ্লানি সব অপমানের জবাব দিয়েছেন স্বামীজি, বন্ধুদের ম্লান মুখগুলি দেখে আনন্দ আরও বাড়ছে। ওদের ওই গর্ব আজ ভেঙে চুরমার। তাদের ধর্মগুরুরা প্রকাশ্যে স্বামীজির কাছে মাথা নত করছে। রাস্তায় রাস্তায় স্বামীজির পোস্টার, কাগজে কাগজে প্রশংসার বন্যা। এই আনন্দের কি তুলনা হয়।এখন তার সঙ্গীরাও চুপ করে শোনে। স্বামীজি যখন ভারতের শ্রমিক কৃষকদের অবদান আর তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গদের শোষণের কথা বলেন, এই শ্রমিকরা নিজেদের খুঁজে পায় ওই শোষিত মানুষদের মাঝে। শূদ্র জাগরনের ডাক দিয়ে তাদের হাতেই ভবিষ্যতের দায়িত্ব তুলে দেন, এই মানুষগুলির চোখও চকচক করে ওঠে নতুন দিনের স্বপ্নে।
২৭ সেপ্টেম্বর, ধর্মসভার শেষ দিন সেদিন। চারদিকে স্বামীজির জয়জয়কার। নিউইয়র্ক হেরাল্ড লিখল,”তিনি এই সভার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।তাঁর প্রাজ্ঞতার কাছে আমরা নিতান্ত মূর্খ।” ধর্মমহাসভার সভাপতি লিখছেন,”উপস্থিত সকল ধর্মের সকল পণ্ডিতের চেয়ে তিনি অনেকবেশি জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী। … তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্য শোনার জন্য লোকে হাঁ করে অপেক্ষা করতো।” লেখা হল,”আমেরিকার ভূখণ্ড আবিষ্কার করেছেন কলম্বাস, আর আমেরিকার আত্মাকে আবিষ্কার করলেন স্বামীজি।” এই মাতামাতির মাঝেও স্বামীজির মন পড়ে আছে ভারতের নিপীড়িত মানুষের মাঝে। আবেগভরা কণ্ঠে তিনি দরিদ্র,সমাজের নিপীড়িত মানুষের কথা বলে চলেছেন। এমনসময় তার বন্ধুর দল নারায়ণকে বলল একবার স্বামীজির সাথে দেখা করাবি। ভারতীয় জানলে ফেরাবেনা তোকে।
ভারি চিন্তায় পরে গেলো নারায়ন। যাকে নিয়ে এতো মাতামাতি, তিনি কি শুনবেন সাধারন এই কুলির কথা। তার সামনেই পৌঁছান যাবেনা বুঝি। আর আবার এই নিয়ে ঠাট্টা করবে সঙ্গীরা। ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার। যাই হোক একটা চেষ্টা সে করবে। বক্তব্যের পরে যখন অন্য বক্তা মঞ্চে উঠেছেন তখন সুযোগ মিলে গেলো। স্বামীজি একবার বাইরে বেরলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরল জনগন। অধ্যাপক,চিকিৎসক,ব্যবসায়ী নানা গন্যমান্য মানুষের ভিড়ের মাঝে প্রানপনে প্রবেশ করলো নারায়ন। তার মলিন বেশ দেখে বিরক্ত হোল সবাই। তবুও নারায়ন চেঁচিয়ে ডাকলো স্বামীজিকে। ভারতীয় পরিচয় দিল। দাঁড়ালেন বিবেকানন্দ,কাছে ডাকলেন। তার পরিচয় পেয়ে আর আবদার শুনে হেসে বললেন ডাকো সঙ্গীদের। তোমরা আছো বলেই এতবড় অনুষ্ঠান করা সম্ভব হোল। ডাকো ডাকো, তোমারাই আগামী বিশ্বের কাণ্ডারি। দৌড়ে বন্ধুদের ডেকে আনল নারায়ন। উত্তেজনায় কাঁপছে সে। স্বামীজি সকলকে পরম উষ্ণতায় বুকে জড়ালেন, তাদের দেওয়া খাবার খেলেন হাসিমুখে।মহান মানুষের এই আন্তরিক স্পর্শে ওইসব দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের তখন দুচোখ বেয়ে নেমেছে অশ্রুধারা। সব অপমান বিভেদ গ্লানি দূর হয়ে যাচ্ছে সেই ধারাপাতে। এক অপূর্ব আনন্দে ভরে উঠেছে তাদের বিবেক।আর নারায়ন গর্বিত চিত্তে স্মরন করছে তার দেশ মা কে। যে দেশকে বিশ্বমঞ্চে সবার ওপরে স্থাপিত করেছেন স্বামীজি।
আজ ১১ ই সেপ্টেম্বর সেই শিকাগো বক্তৃতার শুভ সূচনার দিন। প্রনাম জানাই সেই মহামানবকে।
পার্থ চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র ,,, শিকাগো বক্তৃতার ১৫০ বছর পূর্তির সরকারি পুস্তিকা। নারায়ণ এর নামটি কাল্পনিক।
চিত্র সৌজন্য : গুগল