স্বাধীনতা দিবস: অন্তিম পর্ব

প্রসূন রঞ্জন দাসগুপ্ত
0 রেটিং
1724 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

প্রথম পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibos-part1/
দ্বিতীয় পর্বের লিংক ;
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibas-part2/
তৃতীয় পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota_dibos_3/
চতুর্থ পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibos-part4/
পঞ্চম পর্বের লিংক :
https://www.saabdik.com/swadhinota-dibos-part-5/

উনিশ

শাস্তি

15 ই আগস্ট, 2000

হাসপাতাল পৌঁছাতে প্রায় রাত দুটো হয়ে গেল, দেবা দৌড়ে গেল, গিয়ে দেখল বাবানের কয়েকজন সহপাঠী ও পার্টির 2-3 জন ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, একজন ডাক্তারবাবু ও আছেন, সকলেই গভীর চিন্তিত কয়েক জনের চোখে জল, সেই দেখে  দেবার যাবতীয় প্রতাপ যেন কোথাও হারিয়ে গেল , কোন মতে ভয়ে ভয়ে বলল “ ডাক্তারবাবু বাবান  মানে পার্থ কেমন আছে ?  ঠিক হয়ে যাবে তো ?“ পরিচয় পেয়ে ডাক্তারবাবু বললেন যে “ সম্ভাবনা কমই আছে, কারন পার্থ প্রথমে অনেক গুলো নার্ভের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল, তারপর পরে স্ক্যাল্পেল দিয়ে নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলে তাই প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে এবং নার্ভ ও দুর্বল হয়ে রয়েছে, ব্লাড দেওয়া হয়েছে কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি বরং আরও অবনতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে পেশেন্ট কোমায় চলে যাবে “। পার্থর এক বন্ধু কল্লোল বেডের পাশে ছিল, ও এসে বলল “ পার্থর রুমমেট সুনন্দন রাতে রুমে ছিল না, ভোরে ফিরে দেখে এই অবস্থা , সাথে সাথে ওদের স্যারের সাথে কথা বলে ওয়ার্ডে ভর্তি করেছে। “

ডাক্তারবাবু দেবাকে বললেন “ দেখুন আপনার সাথে আমার পরিচয় ছিল না, কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না, এতদিন আপনার একটু সময় হয়নি আসার ? পার্থ আমার ছাত্র, খুবই ব্রাইট ছেলে ও এবং খুবই ভদ্র, ওর মত ছেলে সেই দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়লো, তারপর থেকে আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনে চলে গেল , মনোবিদ ডক্টর সেন কতবার বলেছিলেন ওর একটা চেঞ্জ একটু গাইডেন্স এর দরকার , 6-7 মাস ধরে ওর বাড়ির লোকের খোঁজ করছিলাম আমরা, তখন কোথায় ছিলেন আপনি ? শুধু আপনাদের নেগলিজেন্স এর জন্য ছেলেটার এই অবস্থা “ । 

দেবার উত্তর দেওয়ার ভাষা ছিল না “ সত্যি সেবার ওই বেআইনি ভাবে মৃতদেহ এনে কাজ করার জন্য পুলিশ বাবান দের ধরার পর দেবা প্রভাব খাটিয়ে ওদের ছাড়িয়ে এনেছিল ঠিকই কিন্তু তার পরে আর সময় দিতে পারেনি, কারন ওর ব্যবসা তথা নেটওয়ার্ক পুরো ভেঙ্গে পড়েছিল , পুলিশ পুরো উঠে পড়ে লেগেছিল, কঙ্কাল ও বডি সাপ্লাই এর প্রায় পুরো চক্র টাই পুলিশের জালে চলে গেছে, এবং এই চক্রের মাধ্যমে দেবা যে অন্যান্য ব্যবসা গুলো করত সেগুলো ও লাটে, দেবা নিজে শুধু পার্টির জোরে দেবা বেঁচে গেছে। আজ তাই ভিকি র মত দেবার অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেছে , দেবা নিজেই হাফিয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে যেকোন দিন পুলিশ ধরতে পারে। এমনকি দেবার আইনি ব্যবসা গুলোর অবস্থাও খারাপ, এখনও সে বিষয়ে কেউ কিছু জানে না, এমন কি দেবা নিজের বাবা কেও জানায় নি, যদিও বহু বছর ধরেই ওনার সাথে দেবার কোন সম্পর্ক রাখে না, তবে দেবা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবে নি যে, যে বাবানকে  ও সব কিছু থেকে এত দূরে রেখেছিল, সেই বাবানেরই আজ এই পরিনতি এবং সেটা পরোক্ষ ভাবে দেবার জন্যই “।

কল্লোল ধরা গলায় বলল “ জানেন কাকু, সেবার আমরা সবাই ছিলাম পার্থর সাথে, আমাদের সবাইকেই পুলিশ ধরেছিল, কিন্তু পার্থর দুর্ভাগ্য কাগজে শুধু ওর ছবিই বেড়িয়েছিল, আসলে ও খুব ভোলাভালা তো, রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকতেও ভুলে গেছিলো, আমাদের ব্যাচের অনেকেই এবং অনেক সিনিয়র-জুনিয়র ও এই নিয়ে ওকে প্যাঁক দিত, হাসাহাসি ও করতো, ও এমনিতেই সেই পুলিশি ঝামেলা নিয়ে বিব্রত ছিল, তারপরে এইসব ঝামেলায় ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল, আমরা ওকে অনেকবার বুঝিয়েছিলাম স্যাররাও গত 6 মাসে কয়েকবার কাউন্সিলিং করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কিছু হয়নি , ও কতবার আপনাদের ফোন করেছিল , কিন্তু পায়নি, কাউকে পায়নি, তাই ছেলেটা নিজেকে শেষ করে দিলো “।

 দেবার মাথা ঘুরে গেল , তাড়াতাড়ি পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো, মনে মনে ভাবল ঈশ্বর পাপের শাস্তি বুঝি এভাবেই দেন। এরমধ্যে বাবানের ঘরের থেকে হাঁকডাক শোনা গেল, সবাই ছুটে গেল, ডাক্তার বললেন “ পেশেন্ট কোমায় চলে গেছে “।

 এমন সময় হাসপাতালে কয়েকজন পুলিশ এসে পার্থর খোঁজ করলো, দেবা জানতো, সুইসাইড অ্যাটেম্পট কেসে পুলিশ তো আসবেই কিন্তু ও আশ্চর্য হল এনাদের সাথে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারকে দেখে। বাকি পুলিশকর্মীরা নিজেদের কাজ করতে লাগলেন, ওই অফিসার এসে কল্লোলের সাথে কথা বলে, দেবার কাছে এলেন।

বললেন “ নমস্কার আমি DSP সুভ্রজ্যোতি পাল, সেই মৃতদেহ পাচার ও কঙ্কালের কেস টা আমিই দেখছি এবং সেই কেসে আপনার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে আর আপনার ছেলের বিষয়ে আপনার সাথে আমাদের দরকারী কথা আছে , হেড অফিসকেও ইনফর্ম করা হয়েছে , আপনাকে আমাদের সাথে একটু আসতে হবে, আশা করি আপনি কো-অপারেট করবেন।

দেবা বলল “ দেখুন আমার ছেলে মৃত্যুসজ্জায় এই অবস্থায় আপনার সাথে আমি যেতে পারবো না, আর আমার বাবা এখনও জীবিত, আমায় তাঁকে জানাতে হবে, তার পর আপনাদের সাথে কথা বলবো “।

সুভ্র বলল “ দেখুন আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে, আমরা চাইলে এখনই আপনাকে তুলে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু মানবিকতার খাতিরে আজ রাত টা আপনাকে ছেলের পাশে থাকার অনুমতি দিচ্ছি,  আমার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর লাগবে, ইব্রাহিম কে? সে কি জীবিত না মৃত? আপনার বাবার সাথে তার সম্পর্ক কি ? আপনি বাবার সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না কেন ? আপনি নিজে কিকি বেআইনি ব্যবসা করেন? মনে মনে উত্তর রেডি করে রাখুন । আমাদের স্টাফেরা এখানেই থাকবে, কাল ফার্স্ট আওয়ারে কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে, এখান থেকে কোথাও যাবেন না।

রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে শুভ্র হাসপাতালে ফোন করলো, জানতে পারলো পার্থর বাঁচার আআর কোন সম্ভাবনা নেই, ও দেবা ওখানেই আছে। শুভ্র ফারুক কে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলল। দুপুর 2 টো নাগাদ শুভ্র জানতে পারলো পার্থ মারা গেছে, ও তাড়াতাড়ি হাসপাতালে এলে দেখে হুলুস্থুলু কাণ্ড দেবা হাতে একটা রিভলবার নিয়ে “ ওকে আমি ছাড়বো না, এই পাপের শাস্তি ওকে আমি দেবই” বলে দৌড়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেল, শুভ্র আর ফারুক একটা মটরসাইকেলে ফলো করলো।

কুড়ি

 শেষ অঙ্ক

15 ই আগস্ট 2000, দুপুর 3 টে

সঙ্গীতা আজ একটু দেরি করেই এল সুধাংশুশেখরের বাড়ি , এসে দেখল উনি বাড়িতে ফিরেছেন আধঘন্টা আগে। ওকে দেখে উনি বললেন বল কি সমস্যা হচ্ছে তোমার ।

সঙ্গীতা বসে ব্যগের থেকে একটা ফাইল বের করে তার থেকে একটা ছবি বের করে সুধাংশুশেখরকে দিয়ে বলল “ স্যার দেখুন তো এনাকে চিনতে পারেন কিনা ?”

ছবিটা দেখে সুধাংশুশেখরের ছবি কিছুক্ষনের জন্য রক্তশূন্য হয়ে গেল, তারপর সামলে নিয়ে বললেন “ এত আমারই অল্প বয়সের ছবি, কোথায় পেলে তুমি ?”

 সঙ্গীতা বলল “ স্যার আমরা মিডিয়ার লোক অনেক সোর্স আছে, দারান স্যার আপনাকে আর কয়েকটা জিনিস দেখাই দেখুন কিছু মনে পরে কিনা “ এই বলে সঙ্গীতা ফাইলের থেকে আর দুটো ছবি বের করে সুধাংশুশেখরের হাতে দিলো , একটা হল অর মায়ের জেঠুর খাতার পাতার থেকে ক্যামেরায় তলা ছবি অ আরেকটা অনেক পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া কলেজ পড়ুয়া তিন জন ছেলের ছবি “।

সুধাংশুশেখর বাকশুন্য হয়ে সঙ্গীতার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঙ্গীতা বলল “ স্যার প্রথমটা হচ্ছে তৎকালীন সময়ের থিয়েটারের মেকআপ আর্টিস্ট ও ড্রেস ডিজাইনার প্রদ্যুত লাহার ডায়েরীর পাতার ছবি ও পরের টা হল কলকাতার এক বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পূর্বপুরুষের ফ্যামিলি এ্যালবামের থেকে সংগৃহীত, আপনার কলেজ জীবনের ছবি , এবার বলুন তো স্যার একেক জায়গায় আপনার ছবি একেক রকম কেন ? আর তাছাড়া আপনি বলেছিলন আপনার মুখ পোড়ে স্বাধীনতার পর ইব্রাহিমের সাথে ওই লড়াই এর সময়, তাহলে ওই ডায়েরির পাতায় আপনার মুখের পোড়া দাগের উল্লেখ এল কি করে ? আরো কিছু প্রশ্ন আছে স্যার আপনি বলেছেন গত 40-45 বছরে গোবরডাঙ্গায় যাননি কিন্তু আপনার ডেসক্রিপশন দিতে অনেকে কিন্তু আপনাকে চিনেছে আর তাছাড়া আপনার ছেলে DD র ইনিশিয়াল কিন্তু রয়েছে প্রত্যেক পাতায়, আর একটা জিনিষও আছে, সেখ ইব্রাহিমের সই, উনি যদি সেই রাতে মারাই গিয়ে থাকেন তাহলে ওনার ভুত এসে কি সই করে গেল? কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে স্যার ? ইব্রাহিম কে? সে জীবিত না মৃত ? আপনি আরেকটা কথাও মিথ্যে বলেছেন, আপনার ছেলের সাথে বহু বছর আপনার কোন যোগাযোগ বা কথা নেই, নাতির খবরও জানেন না আপনি, নাহলে এখন জানতেন ওরা কি অবস্থায় আছে এখন “।  

সুধাংশুশেখর উঠে দাঁড়ালেন , চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে একটু পায়চারী করতে লাগলেন, আচমকা সঙ্গীতার দিকে ঘুরে কি একটা ইশারা করলেন , সঙ্গীতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে কে যেন এক হাত দিয়ে ওর গলাটা চেপে ধরল, অ ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মাথার পাশে একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করল। পেছন থেকে গ্রাম্য টানে একজন বলল সামান্য নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই ঘিলু উড়িয়ে দেব। সঙ্গীতা চিৎকার করে বলে উঠলো “ এটা আপনি খুব ভুল করছেন আমি মিডিয়ার লোক, আমার বর পুলিশ, আপনাদের কিন্তু কেউ বাঁচাতে পারবে না “।

সুধাংশুশেখর হেসে বললেন “ কিচ্ছু হবে না মা, তোমায় কেউ খুঁজে পাবে না, তোমার বর ও বরের বাবা পুলিশ হতে পারে কিন্তু আমার হাত কিন্তু তার থেকেও অনেক অপরে আছে, ওদের কে হাফিস করতেও আমার বিশেষ কষ্ট হবে না, লকে জানবে তুমি বাড়ির থেকে বেড়িয়েছিলে আমার এখানে আসার জন্য কিন্তু পৌঁছায়নি , ইন্টার্ভিউ টা ভালই নিলে তুমি কিন্তু এই বাড়াবাড়িটা কেন করতে গেলে। আর চিৎকার করার চেষ্টা কর না, এই বাড়িতে আমি আর আনিসুর ছাড়া কেউ নেই আর বাইরে যা বক্স বাজছে তোমার আওয়াজ বাইরে যাবে না, আর আমার বাড়ির এদিক দিয়ে রজ হাজার হাজার লোক স্টেশনের দিকে যায় কেউ খেয়াল করবে না। খালি তুমি বল আমার ছেলে আর নাতির ব্যপারে কি বলছিলে ?

সঙ্গীতা বলল “ কিছুই না স্যার আপনার নাতি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় ও আপনার ছেলে পুলিশের জালে এমন ভাবে জড়িয়েছে যে বাঁচার চান্স নেই বললেই চলে, আপনার আপনার ব্যবসা যে লাটে উঠেছে সে খবরও কি রাখেন না আপনি ? “

সুধাংশুশেখর একটু চমকে গেলেন বললেন আমার নাতি মৃত্যুসজ্জায় আর কেউ আমায় জানায় নি, বলে রাগত ভাবে কাকে যেন টেলিফোন করে কি সব জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর ফোন রেখে বললেন আমার লোক খবর নিয়ে জানাচ্ছে তারপর বললেন ব্যবসার অবস্থা আমি আগে থেকেই জানি, কয়েকটা অযোগ্য লোকেদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম তার ফলই হল এই, বলে  রাগত চোখে আনিসুরের দিকে তাকালেন। আনিসুর বলল “আব্বা আপনি চিন্তা করবেন না, প্রথমে এদের কে সাল্টে নি, তারপর ব্যবসা আবার শুরু করব, আমাদের ব্যবসায় তো পুলিশি টানাপোরেন লেগেই থাকে “।

সঙ্গীতা বলল “ বাহ আব্বা , তাহলে এই হল আসল গল্প, আর তুমি তাহলে আনিসুর, তোমাকেও তো পুলিশ খুঁজছে , লুক আউট নোটিশ বেরিয়ে গেছে চারিদিকে, কেউ নিস্তার পাবে না কেউ না, বাঁচাও বাঁচাও “।

সুধাংশুশেখর বললেন “ দেখ তোমায় ছেড়ে দিতে পারি কিন্তু বলতে হবে যে তুমি আর কি কি জেনেছ, আর সব সাক্ষ্য প্রমান আমার হাতে তুলে দিতে হবে , আমার অনেক বয়স হয়েছে, এসব আর ভাল লাগে না, কিন্তু আমায় বাধ্য করলে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলব না। তুমিও সব ভুলে যাবে, এবং আমিও, কারন সব স্তরেই আমার লোক আছে, আমার বিরুদ্ধে কোন আইনি কার্যকলাপ এখনও শুরু হয়নি তা আমি জানি, কারন হলে আমি নিশ্চয়ই খবর পেতাম, তাই ভেবে নাও তোমার প্রান তোমার হাতেই আছে “।

সঙ্গীতা যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল “ ও বলল সাক্ষ্য প্রমান যা এখানেই আছে, প্রথমে আমার পূর্বপুরুষ প্রদ্যুত লাহার ডায়েরিতে আমার শ্বশুরমশাই আপনার নাম দেখেন, তারপর ওই কঙ্কাল পাচার কেসের সময় পুরনো যেসব নথিপত্র পাওয়া যায় সেখানে আমরা দেখি সেখ ইব্রাহিম নামের এক ব্যাক্তির সই আবার গোবরডাঙ্গার ওই কারখানাথেকেও ওই একই ব্যাক্তির উল্লেখ পাই, এমন সময় আমার শ্বশুরমশাই বলেন আপনার হাতে নাকি 50 এর দশকেই ওই সেখ ইব্রাহিমের মৃত্যু হয়েছে, এবং উনি নাকি জানতেন যে আপনার কারখানাও একসময়ে গোবরডাঙ্গায় ছিল, আর একটা ব্যপার ও উনি বলেন যে আপনার থেকে উনি শোনেন যে আপনার গালের ওই পোড়া দাগ ওই ইব্রাহিমের সাথে লড়াইয়ের সময়ই আপনার হয়েছিল, তাহলে ওই প্রদ্যুত লাহার ডায়েরিতে আপনার গালে পোড়া দাগ কোথা থেকে এলো ? তখনই আমার বর শুভ খোঁজখবর শুরু করে। প্রথমে গোবরডাঙ্গা  ও দমদম দুই জায়গারই সার পরীক্ষা করা হয় এবং তাতে সুস্পষ্ট ভাবেই মানুষের হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায় , এরপর আমরা আপনার কথা অনুযায়ী আপনার কলেজের আর্কাইভ ঘেঁটে আপনি কোন ব্যাচের ছাত্র ছিলেন সেটা খুঁজে বের করি, এবং দেখি যে আপনার সাথে কলকাতার তৎকালীন বনেদি বাড়ির কয়েকজন পড়তেন , সবকটি বাড়িতে আমরা যোগাযোগ করি একটি বাড়িতে দেখি আপনার এক ব্যাচমেট এখনও বেঁচে আছেন , কাকতালীয় ভাবে ওনার সেই সময়ে ফটোগ্রাফির শখ ছিল এবং তিনি আপনাদের বন্ধুদের কিছু ফটো তুলিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমরা আপনার অল্প বয়সের ছবি পাই এরপর বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে পাই সেই সময়ের তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড সেখ ইব্রাহিমের সেই সময়ের স্কেচ। অদ্ভুত ভাবে দুটো ছবির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করি, তাতে আমরা ভাবি আপনি ও সেখ ইব্রাহিম বুঝি একই লোক , আমরা এই কাজের কোনটাই অফিসিয়ালি করিনি ভেবেছিলাম শিওর হয়ে লিগ্যালি মুভ করবো , সব এখানেই আছে স্যার প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন, এই অধ্যায় এখানেই সমাপ্ত হোক “।

 সুধাংশুশেখর বললেন “ আনিসুর শুনে নিয়েছিস, মনে তো হয়না ও সত্যি বলছে আর সত্যিটা ওর জানার দরকারও নেই, তুই ওকে ড্রাগের একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ফেলে আয়, আর ওর বর আর শ্বশুর কে আমি দেখে নিচ্ছি, আমার ওই টিম টাকে একটা খবর দে “।

সঙ্গীতা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো , আনিসুর পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে মারল ওর মাথার পাশে, ও চোখে অন্ধকার দেখল, খানিকক্ষণের জন্য সঙ্গাহীন হয়ে পড়েছিল, জ্ঞ্যান আসতেই দেখে ও সোফায় বসে আছে ও আনিসুর পাশে একটা সিরিঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ও চিৎকার করতে চাইল কিন্তু পারলো না।

ঠিক এই সময়ে ঘরে যেন আলোড়ন  পড়ে গেল , হাতে রিভলবার নিয়ে একজন মাঝবয়শি লোক বাবা, বাবা বলে চিৎকার করে ঘরে ঢুকে পড়লো , সুধাংশুশেখর বললেন “ খোকা কি হল, কি হল শান্ত হ, শান্ত হ  “।সঙ্গীতা এই বার বুঝতে পারলো যে এই হল  সুধাংশুশেখর ছেলে দেবব্রত, কোর্টে এঁর মুখোমুখি একবার হয়েছিল সঙ্গীতা , ও আবার বলে উঠলো “ বাঁচান আমায় বাঁচান দেবব্রত বাবু বাঁচান “।

দেবা এই দেখে চিৎকার করে উঠলো “ এখনও , এখনও তুমি শুধরালে না, আর কতদিন কুকর্ম করবে? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে এখনও এই অবস্থা “।

আনিসুর এত কিছুর মধ্যেও ইঞ্জেকশন টা নিয়ে সঙ্গীতার হাতে পুশ কোরতে যাচ্ছিল, দেবা ওই দেখে সোজা আনিসুরকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিলো, আনিসুরের কাঁধে গুলি লেগে ও লুটিয়ে পড়লো, দেবা বলল “ শালা তোর ওই লাশের ব্যবসার জন্য ছেলেটা মরে গেছে আমার , শালা সব জ্বালিয়ে দেব “।

সুধাংশুশেখর চিৎকার করে বললেন “ কি বলছিস বাবান মারা গেছে ? “।

দেবা বলল “ থাক আর ন্যকামো করতে হবে না , তোমার পাপে শুধু তোমার পাপে আজ আমাদের এই অবস্থা, আমার জীবনটা নষ্ট করেছো আমার ছেলের জীবনটা শেষই হয়ে গেল, আমি ব্যস্ত থাকি , কিন্তু তুমি তো বাড়িতেই থাকতে আমি শুনলাম ও তোমার বাড়ির নম্বরে অনেকবার ফোন করেছিল ও কিন্তু তুমি ধরনি, আসলে ধরবে কেন আমরা তো তোমার রক্ত না , তোমার রক্ত তো এই আনিসুর , আমার এত ভালো ছেলেটা শেষ হয়ে গেল ‘।

এমন সময়ে বাইরে অনেকগুলো বুটের শব্দ পাওয়া গেল, দরজা দিয়ে বন্দুক হাতে শুভ্র ও ফারুক ঢুকল, ওরা সব দেখে অবাক হয়ে গেল, সঙ্গীতা কাঁদতে কাঁদতে শুভ্র কে জড়িয়ে ধরল। শুভ্র বলল ‘ তোমায় বারন করেছিলাম একা আসতে তুমি শোননি “।

শুভ্র বলল “ দেবব্রত ও সুধাংশুশেখর দত্তগুপ্ত you both are under arrest “.

দেবা পিস্তল নামিয়ে ফারুকের হাতে তুলে দিলো, এমন সময়ে আচমকা আনিসুর সঙ্গীতা কে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিলো, দেবা ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো কিন্তু গুলি গিয়ে লাগলো দেবার পেটে , ফারুক আনিসুরের বুক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিলো , আনিসুর ওখানেই লুটিয়ে পড়লো। সুধাংশুশেখর চিৎকার করে উঠে কাঁদতে লাগলেন।

শুভ্র এসে দেবাকে জড়িয়ে ধরল, বলল দেবব্রত বাবু এটা কি করলেন, ফারুক তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্স ডাকো , দেবা হেসে বললেন “ অফিসার আমার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না, আমার রোল শেষ, আমি ছেলের কাছে চললাম, আমার সব শেষ, তবে যাওয়ার আগে আপনার প্রশ্নের উত্তর গুলো দিয়ে যাই, আপনারা আজ যে তদন্ত করছেন আমি সেটা অনেক দিন আগেই করেছিলাম, সব ডকুমেন্ট আমার বাড়িতে আপনি সার্চ করলে পেয়ে যাবেন সেলফে রাখা আছে, এই যে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন এ হল মূর্তিমান শয়তান, এঁর নাম হল সেখ ইব্রাহিম রহমান, আর এ হল এক কুখ্যাত রাজাকার, আর যার পরিচয় ভাঁড়িয়ে এ খাচ্ছে সে হল আমার প্রকৃত বাবা সুধাংশুশেখর দত্তগুপ্ত , দেখবেন অনেকের মধ্যে চেহারার একটা সাদৃশ্য থাকে এঁদেরও ছিল, সে যাই হোক আমার বাবা ছিলেন কলকাতায় থাকতেন আর ইনি থাকতেন লাহোরে, যথারীতি ইনি পশ্চিম পাকিস্তানের অনুগত ছিলেন, 50 এর দশকের শেষে যখন তৎকালীন বাংলাদেশে ঊরধু বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তখন সুধাংশুশেখর ছিলেন তার একজন পৃষ্ঠপোষক , তাই ইব্রাহিমকে পাঠানো হয় তাকে শেষ করার জন্য এই বলে দেবা হাঁফাতে থাকে “।

শুভ্র বলল “ আপনি রেস্ট করুন পরেরটা আমরা বলছি, ভুল হলে শুধরে দেবেন, সুধাংশুশেখরকে সপত্নী মারার পর ইনি দেখলেন যে ওর একটা গাল পোড়া, খুব সম্ভবত ইংরেজ দের অত্যাচারে ওই অবস্থা হয়েছিল, এবং ধস্তাধস্তি তে উনুনের ওপর পড়ে গিয়ে ইব্রাহিমেরও গাল পুড়ে যায়, ঘরে ছিলেন আপনি মানে  সুধাংশুশেখরের ছোট্ট ছেলে, ওকে ইব্রাহিম মারতে পারেনি , বরং নিজের ছেলের মতই বড় করেছিলেন, তখনও ইব্রাহিম সুধাংশুশেখরের ভেক ধরেনি, ইনি করলেন কি 4-5 বছর ছোট দেবব্রত কে নিয়ে পিতা পুত্রের ছদ্মবেশে রেল্পুকুরে এসে ওঠেন, ওখান থেকেই ওনার সঙ্গী সাহিলের সাথে শুরু করেন বাংলাদেশ পন্থী লোকেদের খুঁজে বের করে করে নিকেশ করার কাজ, তখনই সাহিলের হাত ধরে তৈরি হয় এই কঙ্কাল পাচার চক্র আর এর ফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করতেন ওই সুধাংশুশেখরের এর পুরনো কারখানা, তারপর একদিন বুঝলেন সুধাংশুশেখরের ভেক ধরলে লাভ বেশী এবং চেহারা গত সাদৃশ্য এবং পোড়া দাগের জন্য তাতে সুবিধাও হয়েছিল , তাই সেই পরিচয় নিয়ে উনি চলে এলেন দমদমে ও এখানে নতুন করে ব্যবসা ফাঁদলেন এবং যে সকল উদ্বাস্তু রা পূর্ববঙ্গ থেকে আসতেন তাদের অনেককে অত্যাচার করে অনেক খবর বের করে নিজের প্রভুদের লাহোরে পাঠিয়ে দিতেন, সে লোকগুলোর কঙ্কালই সম্ভবত আমরা উদ্ধার করেছি বল্লির বিল থেকে। তারপর ইনি যখন বুঝলেন যে বাংলাদেশের মুক্তি আসন্ন, তখন ইনি ইব্রাহিমের পরিচয় পুরোপুরি পরিহার করলেন, তার আগে অব্দি কিন্তু ওই নামেই ইনিশিয়াল করতেন, যদিও ধরা পরার ভয়ে কিন্তু গোবরডাঙ্গায় আর জাননি এরপর রাজনীতিতে এসে হিরো সাজার জন্য গালের দাগ নিয়ে বিরাট গল্প ফাঁদলেন কিন্তু উনি জানতেন না আসল সুধাংশুশেখরের গাল কবে পুড়েছিল ও প্রদ্যুত লাহার খাতা যে আমাদের হাতে এসে পড়বে সেটাও জানতেন না। এরপর একসময় ছেলে ব্যবসার হাল ধরল আর উনি অবসর জীবন কাটাতে লাগলেন, এখন প্রশ্ন হল দেবব্রত কবে জানতে পারলেন ও জানতে পেরেও কিছু বললেন না কেন ও আনিসুর কিকরে ওনার ছেলে হল “।

দেবা বলল “ আমাদের অফিসে একবার রেইড হয়েছিল তখন পুরনো দস্তাবেজে আমি বাবার সই দেখি, ওই হাতের লেখা আমি চিনতাম, তারপর ইজাজ কে চেপে ধরি ওর কাছ থেকেই জানতে পারি যে ইনি আমার বাবা নন বাবার হত্যাকারী, আরেকটা কথাও জানতে পারি যে আমি যে বিপথে যাচ্ছি সেটা জেনেও উনি চুপচাপ ছিলেন, এমন ভাব করে থাকতেন যেন কিছুই জানেন না। আর ওনার সাথে একজনের সম্পর্ক ছিল, পরে তার সাথে আবার ইজাজের বিয়ে হয়, ওর ছেলেই হল আনিসুর, লোকে জানে ও ইজাজের ছেলে কিন্তু আসলে ছেলে হল ইব্রাহিমের, যাই হোক সে সময়ে আমি রাগে অন্ধ হয়ে ওনাকে মারতে এসেছিলাম, কিন্তু ইজাজ আমায় ধরে ফেলে, উনি আমায় বুঝিয়েছিলেন যে সে সময়ে আমিও রাজনীতি তে ঢুকেছি, ব্যবসাও আমিই দেখছি, আবার আমার বিভিন্ন শখের জন্যও অনেক টাকার দরকার, তো ওনার সাথে থেকে ছেলের অভিনয় করে গেলে আমি সবই পেতে থাকবো নাহলে সব যাবে, সে সময়ে লোভে পড়ে ওনার প্রস্তাবই মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু ভেবেছিলাম যে আমার ছেলেকে এর সাথে রাখব না, কিন্তু হায় কর্মফল সেই ছেলেই আমার চলে গেল “।

ততক্ষণে এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের বড় গাড়ি এসে গেছে, দেবাকে নিয়ে  এ্যাম্বুলেন্স রওনা হয়ে গেল, শুভ্র বলল “ আসুন  সুধাংশুশেখর ওরফে ইব্রাহিম, থানায় যাই, আসলে 47 সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু আপনাদের মত শয়তানের হাত থেকে স্বাধীনতা পেতে আমাদের একটু দেরি হয়ে গেল, অবশ্য বিধাতা আপনার শাস্তি দিয়েই দিয়েছেন, আপনার ছেলে মৃত , আরেক “ছেলে” এখন হাসপাতালে, বাঁচবে কিনা কে জানে, পার্থর মত ব্রাইট নাতি আপনার সেও আর নেই, আর কি রইল আপনার, এবার আইনের কাজ আইনের পথে চলুক, খালি দুঃখ সে যুগেও স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রচুর নিরিহ লোক প্রান হারিয়েছিল, আজ আমরা পার্থকে হারালাম, আপনাকে ধরতে পেরে মনে হচ্ছে মিলেনিয়ামের প্রথম স্বাধীনতা দিবস আমাদের সার্থক হল।

সুধাংশুশেখর চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলেন, তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়েই চলেছে।

____________________ সমাপ্ত________________________

 ©প্রসূন রঞ্জন দাশগুপ্ত

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল