একটা পলিথিনের পাউচে দেশি মদ, সাথে থার্মোকলের বাটিতে লাল রঙের ঝাল ঘুগনি নিয়ে #গ্যাঁড়া বসল আমার সামনে৷
দিন কয়েক ধরে মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে আমার, কিছুতেই মানসিক শান্তি পাচ্ছিনা! বেশ কয়েকজন সম্পাদকের গালাগাল খেয়েও লেখা রেডি করতে পারছিনা! প্রতিটা মুহুর্তে মনে হচ্ছে যেন জগতের যাবতীয় সমস্যা সব আমাকে ঘিরে নেত্য করছে৷ ঠিক এই সময়ই হঠাৎ গ্যাঁড়ার কথা মনে পড়ল, ভদ্রলোক বলেছিল, ‘ভাই শান্তি খুঁজে পেতে চাইলে দুটো জায়গায় যাস, শশ্মান আর মদের ঠেক’৷ প্রথমটাকে পাশ কাটিয়ে আপাতত দ্বিতীয়ে আস্থা রাখলাম৷ সকাল সকাল বদন কাকুর দেশি মদের ভাটিতে এসে গ্যাঁড়ার খোঁজ করতেই ভদ্রলোক একহাতে মদ আর অপর হাতে চাট নিয়ে হাজির হল আমার সামনে৷ কিন্তু গ্যাঁড়াকে এই অবস্থায় দেখে মেজাজ ঠিক রাখতে পারলাম না, এমনিতেই মুড অফ ছিল তাই ধমকে উঠলাম,
—নিজে তো শেষ হচ্ছিসই! সাথে সাথে পরিবেশটাকেও শেষ করে ছাড়বি নাকি?
এদিক ওদিক তাকিয়ে গ্যাঁড়া একটা বিচ্ছিরি রকমের মুখভঙ্গী করে বলে উঠলো,
—যাহ্ শ্লা! পরিবেশের আবার কি হল? শরীর খারাপ নাকি? ভাল ডাক্তার দেখা…
সুর সপ্তমে চড়িয়ে বললাম,
—ডাক্তার তো তোদের মত অস্বাভাবিক পাবলিকগুলোর দেখানো উচিত! এই তোরা যারা তিল তিল করে আমাদের চারপাশটাকে ধ্বংস করছিস, পরিবেশটাকে শেষ করে দিচ্ছিস, পৃথিবীটাকে ধ্বংস করছিস, তাদের আগে চিকিৎসা দরকার!
গ্যাঁড়া মুচকি হেসে বলল,
—আরে ভাই! খচে যাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে বলতো? আমি পরিবেশের কি ক্ষতি করলাম আর কি ভাবেই বা তোর ঐ পৃথিবীর ক্ষতি করলাম?
শান্ত হয়ে বসলাম, তারপর রীতিমত ক্লাস নেওয়ার মত করে গ্যাঁড়াকে বোঝালাম,
—দেখ, এই যে তুই পলিথিন গুলো চারদিকে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলছিস! থার্মোকলের বাটিগুলো এদিক ওদিক ফেলছিস! এতেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে! এই যে একটু আগে সামনের কলটায় জল খেয়ে কল বন্ধ না করেই চলে এলি, এতে করে কত সমস্যা হল জানিস? ওরে খবর দেখ, চোখ কান খোলা রাখ! চতুর্দিকে পানীয় জলের জন্য কেমন হাহাকার চলছে! আগামী এক বছরের মধ্যে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চল জলশূন্য হয়ে পড়বে! তারপর ধীরে ধীরে গোটা দেশ, একটা সময় গোটা পৃথিবী! জলের জন্যই হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জলের অভাবে ধ্বংস হবে পৃৃথিবী৷ অথচ এই আমরাই পারি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে! ভূ-গর্ভস্থ জল জমা হতে অনেকটা সময় নেয়, আর সেখানে যত্রতত্র পলিথিন থার্মোকল ফেলে মাটির ওপর নিশ্ছিদ্র আস্তরণ তৈরী করছিস! মাটি নষ্ট হচ্ছে, জমি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে, ড্রেন গুলো সব পলিথিন থার্মোকলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, অল্প বৃষ্টি হলেই জল রাস্তায় উঠছে! গাছ কাটছিস, অক্সিজেন কমছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে… পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশি দেরী নেই রে ভাই! এবার তো একটু ভাব, সচেতন হয়ে ওঠ, পরিবেশের কথা ভাব!
—ঘন্টা….
হঠাৎ করে চমকে উঠলাম! এক মনে পড়া বোঝাচ্ছিলাম, হঠাৎ গ্যাঁড়ার গলা শুনে থমকে গিয়ে তাকিয়ে দেখি ব্যাটাচ্ছেলে এক চুমুকে পলিথিনের প্যাকেটে রাখা মদ টুকু গলায় ঢেলে, থার্মোকলের বাটি থেকে ঝাল ঘুগনি চেটে চেটে খাচ্ছে! বামদিকে অলরেডি পলিথিন ছুঁড়ে ফেলেছে, এরপর ডানদিকে থার্মোকলের বাটি ছুঁড়ে ফেলে পুনরায় সেই কলের জল খেয়ে কল বন্ধ না করেই ফিরে এল! তারপর আমার মুখের কাছাকাছি মুখ এনে পরিস্কার বাংলায় বলল,
—ঘন্টা!
অবাক হয়ে বললাম,
—ঘন্টা!! মানে?
গ্যাঁড়া নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আমার সামনে বসে বলল,
—শোন ভাই! এই পরিবেশ রক্ষার ঠিকা কি আমরা একা নিয়ে বসে আছি নাকি রে? তোদের কোন দায় নেই! স্যাক্রিফাইস শুধু আমাদের মত আম আদমি করবে কেন? তুমি শালা বড়লোকের ছেলেরা মিষ্টি খাবে আর রস বাঁচাবো আমরা! ওসব বাদ দাও কাকা! মরব তো আমরা বটেই, তবে তোদের বাঁচিয়ে মরব না! সব শালাকে নিয়েই মরব!
হতবাক হয়ে উঠে বললাম,
—মানে?
ফুল কনফিডেন্স নিয়ে গ্যাঁড়া বলল,
—’মানে’টা ভীষণ সিম্পল! আচ্ছা, আমাকে পলিথিন ব্যবহার করতে বারণ করছিস কেন? সোজাসুজি পলিথিন প্রোডাকশন বন্ধ করছিস না কেন? আজ যদি বাজারে পলিথিন প্যাকেট সস্তা এবং সহজলভ্য না হয় তবেই তো কাল থেকে আমি অল্টারনেটিভ কিছু ভাববো, তাই না! তা না করে তুমি বাবু নিজের প্রফিটে প্রোডাকশন করে যাবে, আর এদিকে আমাকে বলবে পলিথিন ব্যবহার না করতে? আজব মজা!! তাছাড়া পলিথিন ব্যবহার নিয়ে কি আইন কানুন আছে? সেগুলোর ইমপ্লিমেন্টেশন হচ্ছে কোথায়? হেলমেট না পরলে যেভাবে ফাইন হচ্ছে সেভাবে পলিথিন ব্যবহার যারা করছেন আর পলিথিনে মালপত্র যারা দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক না!
আমাদিকে বলছো ভাই গ্রীণ হাউস গ্যাস বেড়ে যাচ্ছে, অক্সিজেন কমে যাচ্ছে, গাছ লাগাও-প্রাণ বাঁচাও! আরে বাহ্ গুরু! আমরা একটা দুটো করে গাছ লাগাবো, যত্ন আত্তি করে গাছ বড় করব! আর তুমি বাবুদের গাড়ি চলাচলে যাতে অসুবিধা না হয় তাই রাস্তা বাড়াতে হাজার হাজার গাছ কাটা হবে! বুলেট ট্রেন ছুটবে তাই লক্ষ লক্ষ গাছ কাটবে! ভারি মজা!! এতো আজব ব্যাপার… এই যে চতুর্দিকে এত পাইকারি হারে গাছপালা কাটা হচ্ছে, কতজনের পানিশমেন্ট হয়েছে? আমি দুটো গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষা করব আর তুমি ওখানে দুশো গাছ কেটে ডেভেলপমেন্ট খেলবে, ঠান্ডা ঘরে বসে বসে গ্রীণহাউস গ্যাস বাড়াবে আর কমাবার দায় আমাদের! ওটি হচ্ছে না!
আর শোন মাষ্টার, জল নষ্ট করব হাজার বার! কেন করব না? তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ জল কম খরচ করতে, পানীয় জলের অপচয় কম করতে! খুব ভাল… ওদিকে গ্যালন গ্যালন জল তুলে যে নানাবিধ পানীয়দ্রব্যের ফ্যাক্টরী গুলি রমরমিয়ে চলছে, তার বেলা? আমি জামাকাপড় ধোয়ার জন্য শুকনো পুকুর নদীতে ছুটবো, বৃৃষ্টির জল ধরে রাখবো! আর তুমি বাবুদের গাড়ি ধোয়ার জন্য মিনারল ওয়াটার!! গ্রেট ভাই..!!
ভাই শোন, এই সব নাটকগুলো বন্ধ কর বুঝলি! আমি সব বুঝি৷ প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া অপরাধ, সিগারেট বিক্রি বা সিগারেট উৎপাদন নয়! আমি মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলে সেটা অসামাজিক, পুলিশ আমায় তুলে নিয়ে যাবে, মদের ভাটি ভাঙবে! খুব ভাল! ওদিকে যে বাবু তোমরা সামাজিক হয়ে হোটেল বারে মদের ফোয়ারা ওড়াচ্ছো, তার বেলা? নাকি আমি কম দামি মদ খাই বলে #মাতাল, আর তুমি বড়লোকের ছেলে দামি মদ খেলে সেটা হয় #ড্রিংক!
শোন ভাই! বিষবৃক্ষের ছোটখাটো ডালপালা ছেঁটে লাভ নেই, বিষবৃৃক্ষের কাছে কাউকে যেতে বারণ করেও লাভ নেই! পুরো গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হবে তবেই সমস্যার সমাধান হবে! সেটি না করে তুমি বাবুরা প্রতিদিন গাছের গোড়ায় জল দিয়ে দিয়ে বিষগাছ বড় করবে আর আমাদের বলবে সাবধানে থাকতে!! এভাবে, কোন সমস্যার সমাধান হবেনা৷ আমরা ত্যাগ করে তোমাদের ভোগের আয়োজন করব না, এটা পরিস্কার! আমি তো মরবই, তবে তোদের বাঁচার সুযোগ করে দিয়ে মরব না! সবাইকে নিয়েই মরব! আমি তো চাই পৃথিবী ধ্বংস হোক৷ পৃথিবীর এমনিই শরীর খারাপ, বয়স হয়ে গেছে, পুরোপুরি ধ্বংস হোক! তারপর আবার একটা নতুন পৃথিবী তৈরী হোক! আবার প্রথম থেকে শুরু হোক৷ নতুন পৃথিবী সৃষ্টি হোক, যেখানে ন্যুনতম মনুষত্ব নিয়েই তবে মানুষ জন্মগ্রহণ করার অধিকার থাকবে, যেখানে ধর্ম থাকবে না, যেখানে রাজনীতি থাকবে না, যেখানে অন্যায় থাকবে না, যেখানে দূষণ থাকবে না! সেরকম একটা পৃথিবী তৈরী হোক, তাই চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পৃথিবী ধ্বংস হোক’৷
গ্যাঁড়ার কথা শুনে ভীষণ রকমের হতাশ হলাম! এতো নেগেটিভ চিন্তাভাবনা প্রত্যক্ষ করে বেশ খারাপই লাগলো! তবু চেষ্টা করলাম বোঝানোর,
—দেখ ভাই! তুই হয়ত ঠিকই বলছিস! কিন্তু একটা চেষ্টা তো আমাদের করতেই হবে! পৃথিবী তো ধ্বংস হবে, সে না হয় হোক! কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পৃৃথিবী বেঁচে আছে ততদিন যাতে সুস্থ স্বাভাবিক থাকে সেটা অন্তত আমাদের দেখতে হবে! জনগণ কে সচেতন করতে হবে!
গ্যাঁড়া আবারও বিচ্ছিরি রকমের হেসে উঠে বলল,
—কাকে সচেতন করবি? জ ন গ ন কে.. হা হা হা! কোন জনগণকে সচেতন করবি, যারা নিজেরা শিক্ষিত হয়ে বছরের পর বছর ধরে কিছু অশিক্ষিতকে সমাজের মাথা হিসেবে বেছে নেয়? যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও হাতে গোনা নগন্য দুচারটে সমাজবিরোধীর ভয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকে? যারা নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিজের যোগ্যতার হাজারগুন নিকৃষ্ট কারও পা চেটে সাফ করে দেয়? যে জনগণ ডাক্তার পেটায়? যে জনগন মাষ্টার পেটায়? যে জনগণ ধর্ষকের পক্ষে সওয়াল করে? যে জনগণ জেগে ঘুমোয় তাদের?
মাথাটা ভীষণ ধরে গেল! কি বলব না বলব কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম গ্যাঁড়া আরেক পাউচ গলায় ঢালছে! আস্তে আস্তে উঠে পালিয়ে এলাম৷ আজ আর বোঝার অবস্থায় নেই গ্যাঁড়া, নেশা কমলে তখন না হয় আবার বোঝাবো! তবে আপনারা #গ্যাঁড়া_মাতালের কথায় কান দেবেন না! দায়ীত্ব নিয়ে গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান! পানীয় জল অপচয় বন্ধ করুন! পরিবেশ দূষণ কমান…ভাল থাকুন৷
©DipenBhunia, চন্দ্রকোনা৷
চিত্র সৌজন্য : গুগল