বিগত পর্বের লিঙ্ক:-
www.saabdik.com/sarod-protibedon-porbo-1
www.saabdik.com/sarod-protibedon-2
www.saabdik.com/sharod-protibedon-3
আমাদের চেনা মা দুর্গা আমাদের কাছে স্বভাবে আচরণে যেন একসঙ্গে উমা নামের এক গড়পড়তা বাঙ্গালিনী কন্যা, স্ত্রী এবং মাতা। শ্বশুর বাড়ি সুদূর প্রবাসে হওয়ায় যে কন্যার জন্যে তার মা বাবার মাঝে মাঝেই মন কেমন করে ওঠে। বছরে একবার তার বাপের বাড়ি আসার প্রত্যাশায় ব্যাকুল নয়নে চেয়ে থাকেন মা মেনকা। মাঝে মাঝে একটু বেশি বেশি মন কেমন করলে সেই মা মেনকা স্বামী গিরিরাজ হিমালয় কে বলেন ‘ যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী,উমা নাকি আমার কেঁদেছে/ আমি দেখেছি স্বপন নারদ বচন উমা মা মা বলে কেঁদেছে ’। অহরহ এমনটাই তো হয়ে থাকে যে কোনো বিয়ে হয়ে যাওয়া বাঙালি কন্যার পিতামাতার পারিবারিক জীবনে।
অন্য দিকে দুর্গা নিজে একজন মা – যে স্বামী, দুই পুত্র দুই কন্যা নিয়ে ভরভরন্ত সংসারের গৃহিণী। আমাদের দেবী দুর্গা তো সেই পরিপূর্ণ বাঙালি মাতৃরূপিণী হয়েই আসেন আমাদের কাছে।
এমনিতে জিনগত কারণে গিরিরাজের কন্যা হলে দেবী দুর্গার মুখে একটু মঙ্গোলিয়ান ছাপ থাকার কথা, গাড়োয়ালি বা ভুটানিদের মত। কিন্তু না, আমাদের তাঁকে চাই একেবারে আয়তনয়না স্নেহময়ী বাঙালি জননী রূপে – একেবারে আমাদের সুধীরলালের গানের সেই ‘তার ললাটের সিঁদুর নিয়ে/ ভোরের রবি ওঠে / আলতা পরা পায়ের ছোঁয়ায় রক্ত কমল ফোটে’ (গানটি শুনতে চাইলে* শুনতে চাইলে ক্লিক করুন ; থামাতে চাইলে দ্বিতীয় বার ক্লিক করুন।) ।
শুধু মুখ নয় শাড়ি পরাতেও চাই বাঙ্গালিয়ানা। মাটির মূর্তিতে সেই ঠাকুর বাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যে রকম সাড়ি পরার প্রচলন করেছিলেন বাঙ্গালিদের মধ্যে, তেমনি ভাবেই চাই।
লক্ষ্মীর ও সরস্বতীর মুখে চাই বাঙালি লক্ষ্মীশ্রী, যতই যুদ্ধের সেনাপতি হন, কার্তিকের জন্য চাই ফরাসডাঙ্গার ধুতি পরা আলালের ঘরে দুলাল মার্কা বাবুয়ানি। গণেশের জন্যে তেমন আর কিছু করার নেই। নেয়াপাতি ভুঁড়ি আর শুঁড়সুদ্ধ মুখ বলে তাঁর একটা খুব ভালো বাঙালি সংস্করণ বার করা যায়নি। আসলে আমরা যে মা দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিকে পূজা করি সে একেবারে আমাদের বাঙালি মনের মাধুরী দিয়ে সৃষ্ট।
দুর্গার আমরা দুটি কাহিনী এবং রূপ পাই, একটি বৈদিক ও লৌকিক। আমরা দুটি থেকেই কিছুটা অংশ মিলিয়ে মিশিয়ে সেটিকে আমাদের গ্রামীণ জীবনযাপনের ছাঁচে ঢেলে সম্ভবত আমাদের মা দুর্গার উপাখ্যান রচনা করেছি।
প্রথমে পুরাণের গল্পটিতে যাওয়া যাক। মহিষাসুর প্রবল পরাক্রমে দেবতাদের স্বর্গচ্যুত করে দেন। বিপন্ন দেবতারা তখন ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। এদিকে ব্রহ্মাই কোনো এক সময়ে মহিষাসুরকে বর দিয়ে বসে আছেন তাকে কোনো দেবতা বধ করতে পারবেন না। এ অবস্থায় কি করা যায় এ নিয়ে দেবতারা তখন এমারজেনসি মিটিং ডাকলেন। অনেক মাথা চুলকে অবশেষে তাঁরা দুঁদে উকিলদের আইনের ফাঁক বার করার মত করে একটা উপায় বার করলেন।
ব্রহ্মা বর দিয়েছেন কোনো দেবতারা মহিষাসুরকে বধ করতে পারবেন না। কিন্তু কোনো দেবী যদি মহিষাসুরকে বধ করতে পারে তাতে তো কোনো বাধা নেই। ব্রহ্মার দেওয়া বরে তো কোনো দেবীর হাত থেকে মহিষাসুরকে রক্ষা করতে পারবেনা। কিন্তু এমন দেবী কোথায় পাওয়া যাবে। স্বর্গের দেবীরা তো সব ললিত লবঙ্গলতা। এমনিতে তাদের অনেক ক্ষমতা-টমতা আছে। কিন্তু যুদ্ধ-টুদ্ধ করা তো তাদের কম্ম নয়। যাঁরা স্বর্গে আছেন তাদের মধ্যে তেমন কোনো দেবীর কথা তাদের কারো মাথায় এলো না। তখন দেবতারা অনেক ভেবে ঠিক করলেন তারা সবাই নিজের শক্তির কিছু অংশ দিয়ে এক দেবী সৃষ্টি করবেন, যিনি মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন। এমনিতে স্বর্গের সব দেবতাদের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব নেই। প্রচুর ইগোর লড়াই। কিন্তু ঠেলার নাম বাবাজী। তাই একটা ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা হল। নতুন এক দেবীর সৃষ্টি করলেন দেবতারা এবং তাকে সবাই মিলে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের জন্যে জন্য প্রস্তুত করে দিলেন।
শিব দিলেন মুখ,, বিষ্ণু দিলেন দশ হাত, যম দিলেন চুল, ইন্দ্র তৈরি করলেন দেহের মধ্য ভাগ, বরুণ তৈরি করলেন জঙ্ঘা আর উরু, পৃথিবীর দানে সৃষ্টি হল নিতম্ব, কুবেরের তেজে হল নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, চন্দ্রের দানে স্তন যুগল, পবনের দানে হল দুটি কান, ব্রহ্মার তেজ থেকে হল দুটি পা, বসুগণের তেজে হল দশটা আঙ্গুল। এ ভাবেই দেবতাদের মিলিত দানে সৃষ্টি হল মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা।
এই দেবী দুর্গা সুপার পাওয়ার অর্জন করে মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন, প্রথমবার অষ্টভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার দশভুজা দুর্গা রূপে। সেই থেকে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয়।
সত্যযুগে সুরথরাজা দুর্গা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তিন বৎসর কাল ধরে দুর্গাপূজা করেন। ত্রেতা যুগে রাবণ চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার পূজা করেন। যে পূজাকে আমরা বাসন্তী পুজো বলে থাকি। আর শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে রাবণ বধের অভিপ্রায়ে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করে পূজা করেন। সেই থেকে দুর্গাপূজা শরৎ কালেই হওয়ার প্রচলন হয়ে গেল। এ গল্প আমাদের অনেকেরই জানা।
বেদ পুরাণের যে দেবী চণ্ডীর কথা আছে আর লৌকিক মতে যে দেবী চণ্ডীর কথা আছে তার মধ্যে অমিল প্রচুর | দেবী চণ্ডীর উৎপত্তি সম্ভবত লোকমানস থেকে। বলা যেতে পারে Public aspiration থেকে। যেখানে বৈদিক চণ্ডী কে দেখানো হয়েছে সম্পূর্ণভাবে পুরুষ দেবতাদের দ্বারা সৃষ্টি করা, দেবী দুর্গা যেন সমস্ত শক্তিই পেয়েছেন দেবতাদের থেকে, তাঁর নিজস্ব কোনো শক্তি নেই, সেখানে লৌকিক দেবী চণ্ডী এসেছেন আদিম কালের তন্ত্রের শক্তি দেবীর বাহক হয়ে। এ শক্তি পুরুষদের থেকে ধার করা নয়। একেবারে নির্ভেজাল নারী শক্তি। ইনিই বোধহয় জগতের প্রথম নারীবাদী মহিলা। এই লৌকিক চণ্ডীর কোনো সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। লিখিত ভাবে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেই আমরা দেবী চণ্ডীকে পাই। সেই হিসেবে ব্যাধ কালকেতুই প্রথম চণ্ডীর পুজো দেন।
এই চণ্ডী লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে সাধারণ মানুষের গ্রামীণ দেবতা হয়ে যান। এক এক অঞ্চলে চণ্ডী নামের আগে এক একটি সাংকেতিক শব্দ ঢুকে গেছে। ওলাইচণ্ডী বাতাইচণ্ডী এই সব। দেবীমূর্তিও পাল্টে গেছে অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, গ্রাম থেকে গ্রামে। এই লৌকিক দেবীর প্রতিষ্ঠা লোকবিশ্বাস থেকে। বেদ পুরাণ বা অন্য শাস্ত্রগ্রন্থে এর উল্লেখ নেই। পরবর্তী কালে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত উপ-পুরাণে দেবী ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে এই চণ্ডী ঢুকে গেছেন সম্ভবত লোকবিশ্বাসকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা না করতে পেরে। গ্রামীণ লোকবিশ্বাসের মধ্যে কোথাও মাতৃতন্ত্রের প্রাধান্য ছিল । আমাদের প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে পুরুষতন্ত্রই প্রাধান্য পেত। কিন্তু ভূমিসন্তান নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যেই মাতৃশক্তিতে বিশ্বাস ছিল। লৌকিক চণ্ডীকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে তাই কোথাও একটা জনগণেশের কাছে অভিজাত শ্রেণীর পরাজয়ের গল্প লুকানো আছে। কারো কারো মতে দেবতাদের দ্বারা দেবী দুর্গা সৃষ্টির গল্পের পিছনে লৌকিক দেবী চণ্ডীকে মেনে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে পুরুষই আসল সব শক্তির উৎস সেই মতকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের স্বীকৃত ধর্মগ্রন্থে, এবং মহাকাব্যে যে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য আছে তার কারণ এই সব গ্রন্থ রচিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধিদের দ্বারা। লোক সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিলে হয়ত এমনটা হত না।
কিন্তু এই বঙ্গ দেশে ঠিক কবে থেকে মা দুর্গার পুজো শুরু হয় সেটাই আমাদের নিবন্ধের বিষয়। এ বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। অনেক পণ্ডিতের মতে এই বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার শুরু অন্তত এক হাজার বছর আগে। শ্রী চৈতন্যের সমসাময়িক বিখ্যাত বাঙালি স্মৃতিনিবন্ধকার রঘুনন্দন (১৫০০-১৫৭৫) তাঁর ‘তিথিতত্ত্ব’ গ্রন্থে দুর্গোৎসবতত্ত্ব নিয়ে লিখে গেছেন। বিদ্যাপতির (১৩৭৫-১৪৫০ ) গ্রন্থেও দুর্গাপূজার উল্লেখ আছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে সন্ধাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে, চতুর্দশ শতাব্দীতে বৃন্দাবন দাস রচিত ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে এই বঙ্গে দুর্গোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে আমরা এখন শরৎকালে যে ভাবে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে দুর্গার সঙ্গে চার দেব-দেবীকে যে সম্মিলিত রূপে পূজা করে থাকি সেই শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রথম শুরু হয় ১৫৮০ সালে। মোঘল বাদশা আকবরের আমলে বাংলার বারো ভুইঁয়ার এক ভুইঁয়া তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ চৌধুরি এই পূজা শুরু করেন।
হঠাৎ তিনি এই ভাবে পুজো কেন শুরু করলেন ? এর পিছনে গল্প হচ্ছে রাজা কংসনারায়ণ চৌধুরির পিতামহ রাজা উদয়নারায়ণ একটি মহাযজ্ঞ করার পরিকল্পনা করেন। তিনি ডেকে পাঠালেন তাঁর রাজপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীকে পরামর্শের জন্য। তিনি বিধান দিলেন শাস্ত্রে বর্ণিত যে চার প্রকারের যজ্ঞ আছে, বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ আর গোমেধ, এর প্রথম দুটি কোনো সামন্ত রাজার করার নিয়ম নাস্তি। আর কলিকালে অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ করার বিধান নেই। অতঃ কিম ? রাজপুরোহিত টিকি নেড়ে বললেন হুমম একটা উপায় আছে। সেটা হল শাস্ত্র অনুযায়ী দুর্গাপূজা করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ করা যায়। তিনিই রাজা উদয়নারায়ণকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিককে নিয়ে একটি প্রতিমার পরিকল্পনা করে দিলেন। কিন্তু কোনো কারণে উদয়নারায়ণের পক্ষে এই পুজো শুরু করা সম্ভব হয়নি। পরে শুরু করেন তাঁর নাতি কংসনারায়ণ। সুতরাং বাঙ্গালির এই এখনকার মত গোটা দুর্গা পরিবারকে পূজার পরিকল্পনার পিছনে অবদান ছিল রাজপুরোহিত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী এবং রাজা কংসনারায়ণ চৌধুরীর।
তখন কার দিনে এই পুজোতে নাকি আট লক্ষ টাকা খরচা করেছিলেন কংসনারায়ণ। তিনি প্রকৃত সৌখীন এবং গুণীর কদরী ছিলেন। তাঁরই সভায় সভাকবি ছিলেন কৃত্তিবাস। যিনি বাংলায় প্রথম রামায়ণ রচনা করেন।
কংসনারায়ণকে টেক্কা দেবার জন্যে ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎনারায়ণ দশ লক্ষ টাকা খরচা করে দুর্গাপূজা করলেন তবে সে পূজা বাসন্তী দুর্গার। এর পরে তখন কার রাজা রাজড়া দের মধ্যে এই দুর্গা পুজো নিয়ে টেক্কা দেওয়ার খেলা শুরু হল।
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কলকাতার জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রচুর জাঁক জমক করে দুর্গা পুজোর প্রচলন শুরু করলেন নিজের নিজের প্রাসাদে। পরবর্তী কালে ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে হয়ত একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রবণতায় আরো বেশ কয়েকটি পুজোর শুরু হল। এর মধ্যে ১৬১০ খৃষ্টাব্দে সাবর্ণ রায় চৌধুরির বাড়ির পুজো, ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে বরানগরে বংশী দত্তের বাড়ির পুজো, ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে কোলকাতার বিডন স্ট্রীটে রামদুলাল দের বাড়ির পুজো, ১৮০৭ খৃষ্টাব্দে দর্জি পাড়ার মিত্র বাড়ির পুজো, ১৮৩১ সালে পটল ডাঙ্গার বসু মল্লিক বাড়ির পুজো, ১৮৫৫ সালে ঠনঠনিয়ার দত্ত বাড়ির পুজো, ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে জোড়া সাঁকোর নরসিংহ দাঁর বাড়ির পুজো, ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে বহুবাজারে গণেশচন্দ্রের বাড়ির পুজো, ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে শোভাবাজারে অমৃতলাল দাঁর বাড়ির পুজো ইত্যাদি। বড়লোকদের পুজোয় চলতে লাগলো জাঁক জমকের প্রতিযোগিতা। শহরের বাইরে জমিদাররা নিজেদের অধিকারে থাকা গ্রামেও দুর্গাপূজার প্রচলন করলেন। এর মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ঘটলো ১৮৯০ সালে। এবার আর কোনো একজন বাবুর পুজো নয়। হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় বারোজন বন্ধু মিলে শুরু করলেন দুর্গাপূজা। সেখান থেকেই বারোয়ারি কথাটির উৎপত্তি।
অবশ্য প্রকৃত অর্থে সার্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হতে আরো কয়েক বছর লেগে গেল। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মোৎসাহী সভা পুরোপুরি চাঁদা তুলে পুজোর আয়োজন করলেন ভবানীপুরে। সিকদার বাগান ১৯১৩ সালে এবং বাগবাজার সার্বজনীন ১৯১৯ সালে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে চাঁদা তুলে দুর্গাপূজার আয়োজন করে। তার পর এই সার্বজনীন পূজা ছড়িয়ে পড়তে পড়তে আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে।
এই নিবন্ধের শুরুতে যে মাদুর্গার বাঙ্গালি-করণের কথা বলেছি, ঠিক কখন থেকে আমরা দেবী দুর্গাকে আমাদের ঘরের মানুষ করে তুলেছি তার কোনো নির্দিষ্ট উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শাক্ত পদাবলী রচয়িতার যে সব আগমনী গান বাঁধলেন সেখানে গিরিরাজ ও মেনকার কন্যা উমা হয়ে গেলেন একেবারে বাঙালি বাড়ির মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছে শিব বাবাজীবনের সাথে। যে কিনা একেবারে বোহেমিয়ান টাইপের। এই বোহেমিয়ান বাঙ্গালিকে তো আমরা আমাদের সাহিত্যে বার বার পেয়েছি। হয়ত এই ধরণের চরিত্রের প্রতি আমাদের একটা গোপন ভালোবাসা রয়ে গেছে বলেই আমরা শিবকেও সে রকম করে তুলেছি। এই শরৎ কালে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার গল্পটি ঠিক কি ভাবে শুরু হয় তা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।
একটি মতে যে হেতু এই গাঙ্গেয় বঙ্গদেশেই এই চারদিনের পূজার চল হয় এবং গঙ্গার তীরে এমন এক বিশেষ ধরনের মাটি পাওয়া যায় যা দিয়ে অনন্য মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করা যায়, তাই বাকি ভারতে দেবদেবতার মূর্তি পাথর বা ধাতু নির্মিত হলেও এ অঞ্চলে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিরই পূজা প্রচলিত হল। এবং যেহেতু মাটির তৈরি মূর্তি বেশিদিন রাখা যায়না তাকে আবার গঙ্গার জলেই বিসর্জনের প্রথা চালু হল। এই গঙ্গার কাঁচা পলি মাটি নিয়ে এসে তা থেকে মৃন্ময়ী মাতৃ মূর্তি নির্মাণ করে তার পূজা করে তাকে আবার গঙ্গাকে ফিরিয়ে দেওয়া এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে হয়ত এই শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ের বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্যে আসা এবং আবার পিতামাতাকে কাঁদিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার বেদনবিধুর কাহিনিটি সৃষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে আছে বাঙ্গালির হৃদয় উৎস হতে নিঃসারিত আবেগ ও কল্পনার মিশ্রণ।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা যাই থাক। ইতিহাস যাই বলুক। মার্কণ্ডেয় পুরাণের পাতা থেকে নয়, আমাদের মাদুর্গা অপরূপ রূপে বাহির হয়ে আসেন বাংলাদেশের হৃদয় হতে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই বসবাস করুক, বাঙালির কাছে ‘পুজো আসছে’ এই ছোট্টো বার্তাটি পৌঁছালেই সে উদ্বেলিত হয়, একধরনের ম্যাজিক-রিয়ালিটি তে আক্রান্ত হয়। স্মৃতিপটের সত্তর এম এম পর্দায় ভাসে খণ্ডিত দৃশ্যাবলীর মন্তাজ – ফিরোজা রঙের আকাশে ছিন্ন মেঘেদের অলস বিচরণ,চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে দেখা শান্ত নদীটির পাড়ে হাওয়ায় দুলছে কাশ ফুল, এঁদো পুকুরের সব কলঙ্ক ঢেকে দিয়ে অজস্র শালুকের আবির্ভাব, ছিট কাপড়ের নতুন ফ্রক পরা মেয়েটির হাত থেকে উড়ে যাচ্ছে হলুদ রঙের গ্যাস বেলুন, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাঁধা হচ্ছে প্যান্ডেল, মফস্বলের ছোট্টো ক্লাব ঘরে চলছে নাটকের রিহার্সাল, দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাসংখ্যার জন্যে বাড়িতে ছোটোদের মধ্যে চলছে কাড়াকাড়ি, আর পুজোর নতুন গানের জন্যের রেডিওর অনুরোধের আসরে কান পেতে আছে বাড়ির সবাই। আমাদের দুর্গোৎসব তো এই সব নিয়েই। যতটা ধর্ম তার চেয়ে অনেক বেশি বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক সত্তা দিয়ে উদযাপন এই উৎসবের। তাই মা দুর্গাকে উদ্দেশ্য করে শক্তি রূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপে সংস্থিতা এই স্তোত্র উচ্চারণের সঙ্গে বাঙালি বোধহয় নিরুচ্চারে এটাও বলে থাকে-
বাঙালি রূপেণসংস্থিতা।
©️শঙ্খচিল
নিয়মিত চোখ রাখুন শাব্দিকের পেজে,প্রতিটি পূর্ববর্তী পর্বের লিংক পরবর্তী পর্বের সাথে পেয়ে যাবেন..তাই মিস করার কোনো অবকাশ নেই..
চিত্র সৌজন্য : গুগল