মুখোশের আড়ালে

কাজরী চৌধুরী
3 রেটিং
2269 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 2 , গড়ে : 3]

পাঠকদের পছন্দ

পূর্ণিমার রাত | জঙ্গলের প্রতিটি গাছ-পালায় একরাশ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের রূপালী চাঁদ | চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে | কিন্তু এই পরিবেশ বেশিক্ষন স্থায়ী হলনা | রাতের নিস্তব্ধতাকে খান-খান করে ভেঙে চুরমার করেদিল একটা আওয়াজ | বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার আওয়াজ | পর পর দুটো গুলি চললো | পরমুহূর্তেই দেখা গেল এক ব্যক্তি বনবাদাড় ভেঙে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটছে | তার পিছনে ধাওয়া করেছে দ্বিতীয় এক ব্যক্তি | তার হাতে শিকারের বন্দুক | সেই তো গুলি চালালো প্রথমজন কে লক্ষ্য করে |

কিছুদূর এইভাবে ধাওয়া করার পর আবার চললো গুলি | এইবার গুলি লাগলো প্রথম ব্যক্তির পায়ে | সে পরে গেল |পা দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগলো | সে বুঝল যে তার আজকে আর নিস্তার নেই | তার সামনে এসে দাঁড়ালো দ্বিতীয় ব্যক্তি |হাতের বন্দুকটা তাক করা প্রথম ব্যক্তির বুকের দিকে | তার মুখে নিষ্ঠুর এক হাসি ফুটে উঠেছে | এমন সময় দ্বিতীয় ব্যক্তির পিছনে বেশ কাছেই আরো একটা আওয়াজ হলো | তবে এবারের শব্দটা কোনো বন্দুকের গুলির শব্দ না |এটা ছিল এক নরমাংসখাদক প্রাণীর গর্জন| বাঘের গর্জন |

                                ******************

“এখানের পরিবেশ কিরম পলিউশন ফ্রি দেখেছিস!” গাড়ি থেকে নেমে হাত পা স্ট্রেচ করতে করতে বললো বিমান কাকু “এতটা রাস্তা এলাম, কাউকেও একটা হাঁচতে দেখলি?”

“তা অবশ্য ঠিক বলেছো” রিকি বললো “কলকাতার বাইরে এলে এরম পরিষ্কার হাওয়ায় নিঃস্বাস নেওয়া যায় বৈকি!”

পিছন থেকে বিদিশার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল “রিকি যা গিয়ে রতন কাকুকে সব ব্যাগ নামাতে হেল্প কর |আর বিমান , তুমি গিয়ে লজের ম্যানেজারকে খোঁজো | বরং তোমার সাথে আমিও যাই চলো | আর পাপিয়া ,দেখেনে তো কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা গাড়িতে? “

পাপিয়া, অর্থাৎ বিমানকাকুর স্ত্রী, বললো ” না দিদি, কিচ্ছু ফেলে যাচ্ছিনা | আমি আর মোহর সব দেখে নিয়েছি | তোমরা এগোও, আমরা এদিকে দেখছি |”

গাড়ি থেকে নামতে নামতে মোহর বললো “বাহ! কি সুন্দর রোদ উঠেছে এখানে দেখো! দারুন মজা হবে ঘুরতে! তোমাদের আমাকে থ্যাংক ইউ দেওয়া উচিত! আমার বুদ্ধিতেই তো ডিসেম্বরের এই ছুটিতে বিষ্ণুপুর এলে! “

“যা: বাবা!” গাড়ির পিছনদিক থেকে রিকি বলে উঠলো “আমিই তো আগে বললুম যে ডিসেম্বরের ২৫ থেকে মায়ের স্কুল টানা ছুটি আছে, আমাদের কোনো পরীক্ষা নেই, বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার দিকে বেড়াতে গেলে এই সময়টাই আদর্শ! তোর উচিত আগে আমায় থ্যাংক ইউ জানানো!”

“সে হতে পারে “হাত নেড়ে বললো মোহর “কিন্তু দাদা, বিষ্ণুপুরের আইডিয়াটা তো আমিই দিলাম মাকে|”

“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে ” হেসে উঠলো পাপিয়া ” তোরা দুই ভাই বোনই এই বেড়ানোর বুদ্ধি দিয়েছিস, তাই তোদের দুজনকেই আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ | রতনদা তুমি একটু ব্যাগগুলো দেখো, আমরা দেখি ভিতরে কি হচ্ছে |”

হ্যাঁ এটা সত্যি যে এবার দুই ভাইবোনের জেদাজেদিতেই বিপাশা কিছুটা রাজি হলো বিষ্ণুপুরে বেড়াতে যেতে |কিন্তু একা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে যেতে তার সাহস হচ্ছিলোনা | কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান করেদিল বিমান ও পাপিয়া | কাকুও নিজের অফিস থেকে কদিন ছুটি নিলো | তাই ৫ জনে মিলে একটা মারুতি গাড়ির ব্যবস্থা করে চলে এলো বিষ্ণুপুর | এই বিষ্ণুপুর থেকেই এবার গাড়িতে করে আশেপাশের জায়গা গুলো দেখার প্ল্যান আছে ওদের |  যে জায়গাটায় ওরা থাকার ব্যবস্থা করেছে তার নাম ‘ব্যানার্জী লজ’ | আসলে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুদিন দেরি হয়েছে ওদের, ততক্ষনে সব ভালো জায়গা বুক হয়েগেছে| অগত্যা যেখানে জায়গা পাওয়া গাছে, সেখানেই বুক করে চলে আসে ওরা |

যাইহোক, রিকিরা ভিতরে গিয়ে দেখে, ওদের মায়ের সাথে ও বিমানকাকুর সাথে রিসেপশনের একটা ছেলে খুব কাঁচুমাঁচু মুখে কথা বলছে, ” হেঁ হেঁ আসলে স্যার তো এখন ঘুমাচ্ছেন, আমাকেই বলুন কি নামে ঘর বুক আছে |”

বিমান কাকু বললো “দেখুন দুটো রুম বুক থাকার কথা, একটা বিমান ঘোষের নামে আর একটি বিদিশা সরকারের নামে |” 

“এক্ষুনি দেখছি স্যার” বলে ছেলেটা রেজিস্টার বুক দেখতে লাগলো |

“আচ্ছা ম্যানেজারবাবু কি রোজ দুপুরেই ঘুমান?” হঠাৎ করে মোহর প্রশ্ন করে বসলো |

বিদিশা মেয়ের দিকে কটমট করে তাকাতেই রিসেপশনের ছেলেটা বলে উঠলো ” হেঁ হেঁ আসলে ওটা স্যারের বরাবরের অভ্যাস| আমিই কাজ করছি ৬-৭ বছর হয়েগেল | রোজই ১ টা থেকে ৪টা অব্দি স্যার ঘুমান | আমরাই সামলে নি, হেঁ হেঁ | এই দেখুন পেয়েছি আপনাদের নাম, ২৬ থেকে ৩০ অব্দি বুকিং আছে তো?”

“হ্যাঁ,দিন আমরা সই করেদিচ্ছি ” বললো বিদিশা ” আপনি আমাদের চাবি দুটো দিন আর লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন | আমরা লাগেজ রেখেই খেতে আসছি |”

“হেঁ হেঁ তাই আসুন | আমাদের একটা ছেলে যাচ্ছে আপনাদের বড়ো লাগেজগুলো নিয়ে | আসলে আমাদের খাবারের সব ব্যবস্থা হয়েই আছে, হেঁ হেঁ |” 

লজ বললেও, আসলে এটা একটা ৫ তলা বাড়ি | লিফটের ব্যবস্থা আছে | রিকিদের ঘর ৪ তলায় | প্রতি ফ্লোরে ৪ টা করে রুম |ওদের নেওয়া দুটো রুমই পাশাপাশি | একটায় থাকবে বিমান কাকু আর পাপিয়া কাকিমা | আর একটাই রিকি, মোহর আর ওদের মা | ঘরগুলো ভালোই | বাকি ঘরেও বোর্ডাররা এসেগেছে | বাইরে পিছনের দিকে একটা একতলা বাড়িতে ওদের ড্রাইভার রতনের থাকার ব্যবস্থা হলো |

দুপুরে ওরা খেলো ভাত,ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, মাছের ঝোল আর চাটনি| আজকের দিনটা ওদের সকলেরই বিশ্রাম | আগামীকাল থেকে ঘোরা শুরু| সন্ধে থেকে বিমানকাকুর ঘরেই বসলো ওদের আড্ডা |রাত ৮টা নাগাদ ম্যানেজার মধুসূদন বাবু এলো ওদের রুমে আলাপ করতে ওদের সাথে| বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার মানুষটি হাসিহাসি মুখ করে এসে বললেন ” আপনিই বুঝি বিমানবাবু? এই অধমের নামই মধুসূদন বসু| ফোনে তো আপনার সাথেই কথা বলেছিলাম |”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, এসেছি আমরা ৫ জন| আমি, আমার স্ত্রী, আর উনি হলেন আমার বৌদি, সাথে ওনার দুই ছেলে মেয়ে|”

“বাহ বেশ বেশ | তা তোমরা কোন ক্লাসে পর?” শেষের কথাটা রিকি আর মোহরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন মধুবাবু| 

“মোহর তো সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে|আর ওর দাদা রিকি কলেজে পড়ছে, ভূগোল নিয়ে অনার্স|আমরা দুপুর ১.১৫ নাগাদ তো ঢুকলাম, তখন তো আপনি…”

“হ্যাঁ আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম| আসলে বহুদিনের অভ্যাস তো! দুপুরে ভাত খেলেই ঘুম চলে আসে| ৩ তলায় একটা ঘরে আমি থাকি | বাকি ছেলেরাও মাঝেসাঝে ৩ তলায় থাকে| ওই ফ্লোরে চট করে তাই বোর্ডারদের থাকতে দেইনা| যাইহোক আপনাদের আসতে অসুবিধা হয়নি তো? সিন্টু আপনাদের জিনিসপত্র ঠিকঠাক পৌঁছে দিয়েছে তো? আমি না থাকলে ওই সব কাস্টমার সামলায়|”

“হ্যাঁ সে কোনো অসুবিধা হয়নি, খাওয়াদাওয়া ও ভালোই হয়েছে” বিমান কাকু বললো|

“ঠিক আছে” বললো মধুসূদন বাবু “আমি তাহলে আসছি এখন, রাতের অর্ডার দিয়েদেবেন| আর কিছু লাগলে একটু রিসেপশনে জানাবেন|আমি আজ একটু পুরুলিয়া যাবো।আমি না থাকলেও সিন্টু থাকবে| ওই সব সামলে নেবে |”

ম্যানেজারবাবু চলে যাবার পর রিকি বললো “লজটা মনেহয় প্রথমে অন্যকারুর ছিল| ব্যানার্জী লজ চালাচ্ছেন একজন বোসবাবু? দিলে ‘বসু ভবন’ দিতো তাইনা?”

“তুই থাম তো দাদা!” মোহর বলে উঠলো “সবসময় গোয়েন্দার মতো টিকটিক করবিনা! এবছর তো পুজোর আনন্দই মাটি হলো তোর গোয়েন্দাগিরির জন্যে|”

রিকি বলে উঠলো “তা তোকে যেতে কে বলেছিলো দেবীপুর? থাকতিস কলকাতায় মায়ের সাথে| আমি আর কাকুই ঘুরে আসতাম |”

বেগতিক বুঝে মোহর বললো “তা জানতুম নাকি সিরিয়াস কেস হবে? যা হয়ে গেছে, তা গেছে| এখন এখানে এসেছি, থাকবো খাবো ঘুরবো ব্যাস! এর মধ্যে টেনে টেনে কিছু সন্দেহ আনিসনা! আচ্ছা মা, রাতের কি অর্ডার দেবে?”

“তোদের বাপু সবসময়  খাই খাই “বিদিশা বললো “রাতে ভেবেছি রুটি আর তড়কা বলবো| তোমরা বলো বিমান কি খাবে?”

“রুটি আর তড়কাই হোক আজকে সবার” বললো বিমানকাকু “কাল থেকে চর্ব-চোষ্য হবে, কি বলিস রিকি-মোহর?”

“এই এলো আরেকজন পেটুক” পাপিয়া কাকিমা বলে উঠলো “যাই খাও, আজ জলদি শুতে হবে কিন্তু! কাল ভোরে উঠতে হবে| রতনদাকে বলেদিয়েছি যে কালকে মুরাডি ড্যাম, বড়ন্তি, জয়চন্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত, গড়পঞ্চকোট ঘুরবো |”

“যথা আজ্ঞা” বললো বিমানকাকু “এবারের বেড়ানোটা পুরো জমে যাবে মনে হচ্ছে! কোনো ঝামেলায় না পরে ঘুরলেই হলো!”

সবকিছু প্ল্যান করা থাকলেও রিকিরা তখনও জানতোনা যে ওরা বিপদের কতটা কাছাকাছি চলে এসেছে |  

      **********************

“কিরে ওঠ ওঠ!” মায়ের গলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রিকির | চোখ কচলাতে কচলাতে বললো “কি হয়েছে? এতো ভোরে ডাকছো কেন? ” 

“আরে সাড়ে আটটা বেজে গেল এখনো ঘুমিয়ে যাচ্ছিস! বেড়াতে এসে এতো ঘুমোলে চলবে? ওঠ ওঠ, দেখ মোহর আর কাকু-কাকিমাও রেডি হয়েগেছে |”

“ওহ এতো দেরি হয়েগেছে বুঝতে পারিনি!” ঘুম থেকে উঠে চশমা পড়তে পড়তে বললো রিকি “চা হবে তো এখন? চা টা খেয়েই রেডি হচ্ছি |”

চা টিফিন খেয়ে আরো এক ঘন্টা পরে বেরোলো ওরা |টিফিনে ছিল লুচি, আলুর দম আর ডিমসেদ্ধ |যখন ওরা বেরোলো, ততক্ষনে আকাশে কড়া রোদ | বেরিয়েই মোহর বায়না করলো ” চলোনা আগে খেজুর রস খাই | কাল পরশু আবার কখন বেরোবো ,তার থেকে আজকেই খেয়ে দেখি |”

গাড়ির ড্রাইভার রতন একথা শুনে একগাল হেসে বললো ” তা খেজুর রস তো সামনেই আছে | আমায় গতকালই হোটেলের একটা ছেলে বললো যে একটু এগিয়েই একটা গ্রাম পড়বে| সেখানেই একজন ভালো খেজুর রস ওয়ালা বসে রোজ ভোরবেলা| তা ছোটদিদি যখন বলছে,ওখানেই আগে যাবেন নাকি দাদাবাবু?” শেষের কথাটা বিমানকাকুকে উদ্দেশ্য করে বলা |

“হ্যাঁ তাই চলো আগে, কিন্তু এই রাস্তা ধরলেই কি আমাদের মুরাডি ড্যাম যেতে সুবিধা?” জিজ্ঞাসা করলো বিমানকাকু |

“হ্যাঁ এই রাস্তা দিয়েই আমরা মুরাডি ড্যামের দিকে যাবো| তাই অসুবিধাও হবেনা|” বললো রতন |

প্রায় ১০ মিনিট এগিয়ে দেখতে পাওয়া গেলো খেজুর রস ওয়ালাকে| ততক্ষনে সেখানে ভিড় জমে গেছে| গাড়ি থেকে নেমে ওরা সবাই এগিয়ে গেল ওদিকে| জায়গাটা বেশ ফাঁকা| মাঠই বলা চলে|একটু দূরে কিছুটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে| তারপাশেই একটা জলাশয়| দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে | 

“এই ফাঁকা জায়গাটায় পিকনিক হয়?” রিকি জিজ্ঞাসা করলো ওর মাকে “কটা জায়গায় ঝান্ডা মতো পোঁতা আছে মাটিতে দেখলাম| তা এরম জঙ্গলের সামনে লোক আসে?”

“তাই হবে হয়তো, এই সময় অনেকে তো আসে এদিকে পিকনিক করতে| খোলা মাঠ, চারিদিকে ঝকমকে রোদ |পাশেই নদী,দূরে পাহাড়| সবাই আসে, আনন্দ করে ,আড্ডা দেয়,খাওয়া-দাওয়া করে|” বললো বিদিশা |

“আর ঘুমায়” বলে উঠলো পাপিয়া কাকিমা “দূরে ওই বড়ো ঝোপের পাশে দেখ একজন পরে পরে ঘুমাচ্ছে| পিকনিক করতে এসে লোকে ঘুমায়, সেটা আজ প্রথম দেখলাম |”

“হ্যাঁ তাইতো দেখছি” রিকি বললো “আসে পাশে আর কাউকে দেখছিনা| লোকটার সঙ্গী-সাথী কেউ নেই নাকি?”

“আশেপাশে ঘুরছে হয়তো “মোহর বললো “নদীর পাশে গেছে হয়তো ঘুমন্ত লোকটাকে একা ফেলে|”

“তাই হবে হয়তো” বললো রিকি| এই বলে কিছুক্ষন ও ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকলো| তারপর “তোমরা খেজুর রস ,গুড় নাও, আমি আসছি একটু নদীর ধার থেকে” এইবলে ও ফাঁকা মাঠ দিয়ে নদীর দিকে হাঁটা দিলো |

“দেখো দেখি, অচেনা জায়গায় হুটহাট চলে যাওয়া দাদার বরাবরের স্বভাব” বললো মোহর “দেখো আবার কখন আসে! আবার কাউকে ডাকতে যেতে হবে|”

বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা, কিচ্ছুক্ষন পরেই মাঠের ওপ্রান্ত থেকে ছুটতে ছুটতে এলো রিকি| এসেই হাঁফাতে হাঁফাতে বললো “কাকু একবার এসো একটু দরকার আছে “| ওর হাত থর থর করে কাঁপছে |

“কি হলোরে? কিছু আছে নাকি ওদিকে? কাঁপছিস কেন? চল দেখি কি দেখাচ্ছিস?” এই বলে বিমান কাকুও গেল রিকির সাথে মাঠের ওদিকে | 

একটু পরে দুজনেই ফিরে এলো| বিমানকাকু থমথমে মুখে বললো “তোমরা সবাই এখানে দাঁড়াও| ওদিকে যেওনা কেউ| মাঠে পরে থাকা লোকটা জীবিত না|”

“মানে? কি বলতে চাইছো ওটা ডেডবডি?” পাপিয়া কাকিমা প্রায় চেঁচিয়েই বলে উঠলো| সাথে সাথে আশেপাশে যারা খেজুর গুড় কিনছিল তারাও সব ঘিরে ধরলো ওদের “কি বলছেন? মৃতদেহ ওটা? কি কেস দাদা সুইসাইড? নাকি খুন?”

বিমান কাকু সবাইকে হাত তুলে বোঝাতে থাকলো “আপনারা সবাই এখানেই দাঁড়াবেন| কেউ নড়বেন না অথবা মাঠের ওদিকে যাবেন না| আমি অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ কে খবর দিয়েছি| আমি একজন সাংবাদিক| আপনারা কাইন্ডলি এখানেই দাঁড়ান|” এই বলে কাকিমার দিকে তাকিয়ে কাকু বললো “তুমিও বৌদি আর বাচ্চাদের নিয়ে গাড়িতে চলে যাও|রতনের সাথে ওখানেই বসো| আমি ক্যামেরাটা নিয়ে একটু আসছি|”

“ঠিক আছে, তাই যাচ্ছি|” বললো পাপিয়া কাকিমা |

বিমান কাকু ছাড়া রিকিরা সবাই গাড়িতে গিয়ে বসলো | কিছুক্ষন পরে অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ এলো| এসে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো| ততক্ষনে রিকিদের গাড়ির পিছনে আরো একটা বড়ো গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে| তার থেকেও কয়েকজন লোক নেমে পড়েছে| সেই গাড়ির ড্রাইভারও রতনদার সাথে মৃতদেহের ব্যাপারে গল্প করতে লাগলো| পুলিশ সবাইকে একএক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলো| রিকি গাড়ির ভিতর থেকে বাকিদের সবার আচরণ লক্ষ্য করছিলো| প্রায় এক ঘন্টা পর পুলিশের সাথে নানা কথাবার্তা বলে গাড়িতে ফিরে এলো বিমান কাকু|

গাড়ি আবার চলতে লাগলো গন্তব্যে| বিমানকাকুই কথা শুরু করলো ” যার ডেডবডি পাওয়া গাছে, সে স্থানীয় নয়| কদিন আগেই এসেছিলো হয়তো এখানে| পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে স্থানীয় লোকদের|তা পুলিশের প্রাথমিক অনুমান গতকাল রাতেই শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে লোকটাকে| এখনো পরিচয় জানা যায়নি, তবে পুলিশ তদন্ত শুরু করবে|”

“মানে খুন হয়েছে?” বিপাশা জিজ্ঞাসা করলো “বেড়াতে এসে কেউ খুন করেদিল? তাহলে তো ও যাদের সাথে এসেছিলো তাদের ধরলেই হয়|”

“সেসব পুলিশের কাজ ” বললো বিমান কাকু “আমি নিজের পরিচয় দিয়েছি| আর আমার চেনাজানা হাওড়ার কয়েকজন পুলিশ অফিসারেরও নাম উল্লেখ করেছি | কিছু পেলে আমাকে আপডেট করবে ওরা| আর রতন আমাদের পরের গাড়িতে কারা ছিল? পুলিশ তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে|”

“আপনাদেরই হোটেলের গাড়ি স্যার” বললো রতন “গতকাল আমার সাথে ওদের ড্রাইভারের আলাপ হয়েছিল| ওখানেরই কয়েকজন হোটেলের বড়োগাড়ি ভাড়া করে ঘুরছে| ওখানে ভিড় দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলো যে কি ব্যাপার|”

“বুঝলাম| আচ্ছা রিকি তুই এখন ঠিক আছিস তো? তুই বুঝলি কিকরে ওটা ডেডবডি?”

“হ্যাঁ কাকু ঠিক আছি এখন” বললো রিকি “লোকটাকে দেখে ঘুমিয়ে আছে মনে হলেও ভালোকরে লক্ষ্য করে দেখলাম যে, বডিটা ওঠা-নামা করছেনা |শ্বাস চললে মানুষের শরীরে আপনিই একটা স্পন্দন হয় |আমি গিয়ে নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম হাওয়া চলাচল করছে কিনা| করছেনা দেখেই তোমায় ডাকতে গেলাম| আরো একটা কথা| পিছনের গাড়িটা আমাদের হোটেলের হলে, আমার মনেহলো কয়েকজন এই মৃতব্যক্তিকে চেনে|”

“সেটা কিকরে বুঝলি?”

“পুলিশ মৃতদেহের ছবি দেখাচ্ছিল সবাইকে| তখনি কথা বলার সময় কয়েকজনকে দেখলাম বারবার মুখে, চোখে হাত দিচ্ছে | মানুষ কিছু গোপন করতে চাইলে এরকম করে| ছবিটা দেখার পরেই তাদের মুখ-চোখের হাবভাব বদলে যায়| যদি পুলিশকে জানায় তবেই ভালো| গোপন করলে সন্দেহ বাড়বে|”

“আচ্ছা| ঠিক আছে এবার আবার বেড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করাযাক| এইসব খুন -খারাপির মধ্যে এবারে আমাদের না ঢোকাই ভালো| বেড়াতে এসেছি সবাই মিলে| মন-খারাপ না করে আনন্দ করাই আমাদের এবারের টার্গেট|” 

বিমানকাকু একথা বললেও সবার মন তখনও ঐদিকেই পরে|

যাইহোক প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা জার্নি করার পর সবার পাঞ্চেত পৌছালো | আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে এবং দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে সকালের কথা প্রায় সবাই ভুলেই গেল| এরপর ওরা যায় গড়পঞ্চকোট |দেরি হয়ে যাবার জন্যে জয়চন্ডী পাহাড় ও মুরাডি ড্যাম যাওয়া ওদের বাতিল করতেই হলো| রিকির মা আর পাপিয়া কাকিমা একটু-আধটু কেনাকাটা করলো| সন্ধ্যার টিফিন ওরা বাইরেই করলো| তারপর সবাই গাড়িতে করে হোটেলে ফিরে এলো| ফিরতে রাতই হলো |

ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষন আড্ডা মেরে ওরা সবাই গেল খেতে| রাতের মেনু ছিল রুটি, ফুলকপির তরকারি আর মুরগির কারি| তখন হোটেলের সবার মুখে মুখে খুনের ঘটনা চাউর হয়েগেছে| ম্যানেজার মধুবাবুও চিন্তিত মুখ করে ঘুরছে| খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিমান কাকুর সাথে কথা বললো রিকি “খেতে যাবার আগে দেখলাম কাউকে ফোন করছো |পুলিশ কে নাকি? কিছু জানতে পারলে?”

বিমান কাকু বললো “হ্যাঁ| লোকটার পরিচয় জানা গেছে| নাম কিশোর চৌধুরী|৩৭ বছর বয়েস| পরিবারে বিধবা মা ছাড়া কেউ নেই|এখানে এসেছিলো হওয়া বদলের জন্যে|কিন্ত একাই এসেছিলো,  কেউ সাথে আসেনি| বিষ্ণুপুর ছাড়িয়ে গ্রামের একটা ছোট গেস্ট হাউসে উঠেছিল| কি কাজে এসেছিলো তা জানা যায়নি| তবে পুলিশ দেখছে আশেপাশের কারুর সাথে কোনো যোগাযোগ বেরোয় কিনা|”

“আচ্ছা| আর গুড় ওয়ালা তো ভোরবেলায় বসে| অনেকে খেজুর গুড় পাড়তে যায়| কেউ কিচ্ছু দেখেনি?”

“না| আসলে আশেপাশে সেরম বুনোঝোপের জঙ্গল ছাড়া গাছপালাও নেই| আর খেজুর ওয়ালা বয়ানে বলেছে যে, তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল| তাই তার বসতেও দেরি হয়েছে| ভিড় থাকায় ঐদিকে নজরও যায়নি |”  

“আচ্ছা বুঝলাম| ঠিক আছে তুমি একবার প্রদীপ কাকুকে খবর দিও তো কলকাতায়|কাকু তো ও.সি| কিছু যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে জানিও|”

“সে তো জানাবো| কিন্তু রিকি, এইবার তুই খুনোখুনিতে বেশি ঢুকিসনা| বৌদি আর মোহর অনেকদিন পর এসেছে| তুই না আনন্দ করলে ওদের ঘোরা মাটি হবে| বুঝলি?”

“আচ্ছা ঠিক আছে| “হাসলো রিকি” তোমার কথাটা মনে রাখবো |”

                * *******************

আগামীকাল রিকিদের ঘোরার কথা ছিল অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে| সেইমতো ওরা সকাল সকালই বেরোলো ঘুরতে| সকাল বেলা ওরা গেল অযোধ্যা পাহাড় আর বামনী ফলস| পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় আশেপাশে বেশ কয়েকটা সাইন বোর্ড দেখা গেল হরিণ আর হাতির ছবি দেওয়া| সেগুলোর দিকে হাত দেখিয়ে মোহর জিজ্ঞাসা করলো “এখানে কি হরিণ আর হাতি বেরোয়?”

রিকি উত্তর দিলো “হ্যাঁ বেরোতেও পারে| এখানে সেইজন্যে সাইন বোর্ড দেওয়া আছে| হয়তো আসেনা| গভীর জঙ্গলের দিকে থাকে| তাও রাত-বিরেতে মাঝে-সাঝে বেরোতে পারে বৈকি!”

“ওহ আচ্ছা| তাহলে কি হরিনের মাংস পাওয়া যাবে এখানে?”

“হরিণ মারা এখন এখানে নিষিদ্ধ হয়েগেছে| তাও কি প্রাণীহত্যা কমছে? কত চোরা-শিকারী আসে, তারা হরিণ মারে, হাতি মারে|বিদেশের বাজারে মোটা দামে বিক্রি করে হরিনের মাংস,চামড়া ,হাতির দাঁতের জিনিস| তবে এইসব বন্ধ করতে মনেহয় ফরেস্ট রেঞ্জাররা কড়াকড়ি পদক্ষেপ নিচ্ছে|”

“বুঝলাম| এইসবের জন্যেই তো আরো প্রাণী বিলুপ্ত হয়েযাচ্ছে তাইনা?”

বিদিশা বললো “হ্যাঁ সেই কারণেই তো হচ্ছে| বাঘ যেমন বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে|চোরা শিকারিদের এই শিকার যতদিন না কমবে, ততদিন এইসব প্রাণীর মুক্তি নেই|এই জন্যে মানুষের লোভ আর হিংসাই দায়ী|” 

“আচ্ছা এখানে বাঘ বেরোয়না মা?”

“না সে বেরোয়না|আশেপাশে জনবসতি আছে তো|আবার টুরিস্ট স্পট| এখানে বাঘের দেখা মিলবেনা|”

সকালের ঘোরাটা ভালোই হলো| পাহাড়ের আশেপাশে কোনো নেতা-মন্ত্রী আসবে তাই অনেক পুলিশ দেখা গেল| দুপুরে ওরা একটা হোটেলেই খেয়ে নিলো| মেনু ছিল ঘি ভাত ,ডাল,বেগুন ভাজা আর মাছের কালিয়া| খেতে খেতে বিদিশাই আগেরদিনের কথা তুললো “আচ্ছা বিমান, ঐযে লোকটা মারাগেলো,ওর কিছু পরিচয় পাওয়া গেল?”

বিমানকাকু বললো “ওসব কথা এখন তুলছ কেন বৌদি? বাচ্চারা এসেছে ঘুরতে, এসবের মধ্যে নাক না গলানোই ভালো|”

“তাও” বিদিশা বললো “কৌতূহল তো হয় বোলো| চোখের সামনে এমন দেখলাম …”

মোহর বলে উঠলো ” হ্যাঁ কাকু বলোনা প্লিজ| প্রমিস করছি বেশি নাক গলাবোনা|”

“আচ্ছা তবে তাই” এই বলে বিমানকাকু আগেরদিন যাযা জেনেছে সব জানালো বাকিদের | তারপর বললো ” গতকাল রিকির সাথে আমার এনিয়ে দুটো কথা হয়| আজ সকালে যখন পুলিশকে ফোন করলাম, তখন আরো কিছু জানতে পারলাম | কিশোরের চিটফান্ডের ব্যবসা ছিল|এর আগে ওর এর দূরসম্পর্কের মামার সাথে মশলা আমদানি রপ্তানির ব্যবসা ছিল | কোনো দুর্ঘটনায় মামা মারা যায় | তার কয়েক বছর পর কিশোর এই ফান্ডের ব্যবসাতে আসে | গত ৫ বছর ধরে ও এই ব্যাবসার সাথে যুক্ত | প্রথমে ঠিক-ঠাক চললেও পরের দিকে লোকের টাকা মারতে থাকে কিশোর | পুলিশের খাতায় বেশ কিছু অভিযোগও দায়ের হয়েছিল | কিন্তু এব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই খুন হয়ে গেল ভদ্রলোক | রাত্রিবেলা গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে| হাতে গ্লাভস পড়েছিল খুনি, তাই কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি |তবে ফাইট করেছিল লোকটা। নখের মধ্যে কিছু সোয়েটার বা ওই জাতীয় কিছুর রোঁয়া পাওয়া গেছে। খুনি কিশোরের পূর্ব পরিচিত বলে আন্দাজ করছে পুলিশ |”

রিকি জিজ্ঞাসা করে “আমাদের হোটেলের লোকেরা কেউ চিনতো কিনা কিছু জানতে পারলে?”

টমেটোর চাটনিটা চেটেপুটে খেতে খেতে কাকু বললো “হ্যাঁ জানতে পেরেছি| তোর আন্দাজই সঠিক| টোটাল ৩ টা ফ্যামিলির সাথে কিশোরের যোগসূত্র পাওয়া গেছে| একটা হলো দোতলার ২ নং রুমের এক স্বামী- স্ত্রী ,রমেশ দাস আর সবিতা দাস | সবিতা হলো কিশোরের দূরসম্পর্কের কোনো এক খুড়তুতো দিদি| ওরা দুজনেই গতকাল পুলিশের কাছে গিয়ে বয়ান দিয়ে এসেছে| অল্প যোগাযোগ থাকলেও ওরা জানতোনা যে কিশোরও এখানে এসেছে|গতকালই জানতে পারে|ওদের শেষ কথা হয়েছিল কয়েকমাস আগে| কিশোর ওদের যোগাযোগ করেছিল কিছু টাকা ধার চেয়ে| কিন্তু ওরা দিতে রাজি হয়নি|যাতে থাকার-ঘোরার কোনো সমস্যা না হয় তাই কাউকে না জানিয়েই ওরা পুলিশের কাছে গেছিলো|এখনো অব্দি এদের মোটিভে কিছু পাওয়া যায়নি| এছাড়া বাকি যে দুটো ফ্যামিলি এসেছে, তাদের সাথে যোগসূত্রতা বেশ অদ্ভুত|”

“কেন অদ্ভুত কেন?”

“কারণ পাঁচতলার ১ নং ও ৩ নং রুমের বাসিন্দা দুটো পরিবারই একসাথে এসেছে এবং কলকাতায় খবর নিয়ে জানা গেছে এই দুটি পরিবারই কিশোরের চিট-ফান্ডের প্রতারণা দ্বারা প্রতারিত|”

“বলো কিগো! তাহলে কি ওরাই মেরেছে? মোটিভও ছিল ওদের| কেকে আছে রুমগুলোয়?”

“১ নং রুমে আছেন নিখিল চক্রবর্তী| বয়স্ক ভদ্রলোক| রিটায়ার্ড মানুষ| স্ত্রী-ছেলের সাথে বেড়াতে এসেছেন| আর ৩ নং রুমে আছেন সমরেশ পাল| নিখিল বাবুর বন্ধু| বিপত্নীক মানুষ| পেশায় চিত্রশিল্পী| এদেরকে পুলিশ এখনো জেরা করেনি, কিন্তু কতটা কি জানতে পারবে টা বোঝা মুশকিল|”

“দেখাই যাক| আশা করছি ফিরে এদের সাথে দেখা হয়েযাবে আমাদের|”

বিকেল বেলা কেষ্টবাজার ড্যাম ও লোহারিয়া মন্দির দেখে হোটেলে ফিরলো রিকিরা| সন্ধেবেলায় হোটেলেই কচুরি তরকারির অর্ডার দিয়ে ডাইনিং রুমে বসলো ওরা| আরো কয়েকজন বোর্ডার আশেপাশে বসেছিল,কেউ বাইরে ঘুরছিলো| কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে কর্মীদের সাথে কিসব কথা বলছিলেন ম্যানেজার মধুবাবু| ওনাকে হাত নেড়ে ডাকলো বিমানকাকু|মধুবাবু হাসি হাসি মুখ করে এসে দাঁড়ালেন “কিরম ঘুরছেন আপনারা? থাকতে অসুবিধা হচ্ছেনা তো?”

“না সে হচ্ছেনা| আর আপনাদের রান্নাও ভালো| তা যেটা বলছিলাম, খুনের ঘটনাটা শুনেছেন তো?”

“কি বাজে ব্যাপার বলুনতো!” মধুবাবু হাহাকার করে উঠলেন “আমার হোটেলের এতো কাছে ঘটেগেলো, কি বদনাম হবে বলুন তো! ভাগ্গিস কোনো বোর্ডার জড়িত নয়!  নাহলে আমিতো এইসব পুলিশের চক্করে একেবারে ফেঁসে যেতুম!”

রিকিরা একবার নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো| তারপর রিকি বললো “আচ্ছা জেঠু পাহাড়ের রাস্তায় সাইন বোর্ডে দেখলাম যে জঙ্গলে হাতি, হরিণ আছে| বাঘ নেই?”

একথায় মধুবাবুর মুখ গম্ভীর হয়েগেলো| তিনি বললেন “না বাঘ নেই| আগে হয়তো ছিল| এখন আর নেই| আর বাঘ থাকলে আমি আর এখানে থাকতুমনা| একবার বাঘের ডাক যা সামনে থেকে শুনেছিলাম ,আর বাঘ দেখার ইচ্ছা নেই|”

“কেন জেঠু? কিছু হয়েছিল নাকি বাঘ রিলেটেড?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মধুবাবু | তারপর বলতে শুরু করলেন: “ঘটনাটা হলো প্রায় ১০ বছর আগের | ৩-৪ জন বন্ধু মিলে গেছিলাম সুন্দরবনে বেড়াতে | তখন কম বয়েস, রক্ত ফুটছে যেন! একদিন রাতের দিকে সবাইমিলে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের দিকে , কারুর বারণ না শুনেই | বড়ো রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে সবাই যে কখন এদিক ওদিক হয়েগেছি ,তা বুঝতে পারিনি |   কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ করে আমার কানের পাস্ দিয়ে সাঁই করে একটা গুলি চললো | ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে |হাতের বন্দুকটা আমার দিকেই তোলা | কিছু বোঝার আগেই আবার একটা গুলি চললো | এবার আর দাড়াঁলামনা | প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগলাম জঙ্গলের দিকে | লোকটাও আমায় তাড়া করতে লাগলো | কিছুদূর যাবার পর আমার পায়ে গুলি করলো লোকটা| পড়েগেলাম মাটিতে |লোকটাও দেখি আমার বুকের দিকে তাক করলো বন্দুক | ভয়ে চোখ বুঝে ফেলেছিলাম| হঠাৎ করে কাছা-কাছি কোথাও একটা বাঘ দেখে উঠলো | ওই আওয়াজেই বোধ হয়, লোকটা পালিয়ে গেল | আমিও জ্ঞান হারাই | পরেরদিন সকালে জ্ঞান ফেরে হসপিটালে | জানতে পারি যে ওই অবস্থায় বেশ কিছুক্ষন পড়েছিলাম | বন্ধুরা স্থানীয় লোকদের নিয়ে খোঁজ করায় জঙ্গলের ধরে আমাকে পরে থাকতে দেখে | ওদের মতে চোরা শিকারির খপ্পরে পড়েছিলাম | সেদিন আমার খুব ভালো ভাগ্য ছিল যে মানুষ আর বাঘ- দুইয়েরই খপ্পর থেকে বেঁচেছিলাম | কিন্তু বারবার তো আর এরম কপাল হবেনা ! এই ঘটনার পরেই কাজের সন্ধানে চলে আসি এদিকে | বানার্জীবাবুর এই লজের ম্যানেজার হয়ে বসলাম | উনিতো আসেন বছরে দু-একবার| আমাকেই সামলাতে হয় |”

“ও তাহলে আপনি আসল মালিক নন?” প্রশ্ন করলো বিমানকাকু|

“নো স্যার| আমি ম্যানেজার| মালিক মাঝে-সাঝে আসেন, আমার পাশের ঘরেই ওঠেন| এক সপ্তাহ পর আবার ঘরে তালা মেরে চলে যান|”

ততক্ষনে টিফিন চলে আসে| মধুবাবুও কাজে ব্যস্ত হয়ে বিদায় নেন| খাওয়া দাওয়া করে মোহর দেখে, লজের সামনের খোলা বারান্দায় দুজন বয়স্ক লোক বসে| একজনের হাতে চা, অপরজনের হাতে তুলি| সামনে বড়ো আঁকার খাতা|

রিকিকে একথা জানাতে ও সঙ্গে সঙ্গে বললো “আয়তো আমার সাথে| দেখে আসি কি ছবি আঁকছে |”

    *********************

“আপনারা এখানে কি করছেন? ছবি আঁকছেন?” বয়স্ক দুই ভদ্রলের কাছে গিয়ে মোহর জিজ্ঞাসা করলো| রিকি ওই পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল |

যে ছবি আঁকছিলো, সে কোনো উত্তর দিলোনা| শুধু গম্ভীর মুখ করে তাকালো ওদের দিকে| অন্যজন হাসলো আর বললো “তোমরা বুঝি এখানেই উঠেছ? তোমাদের নাম কি?”

মোহর বললো “আমার নাম মনীষা সরকার | এটা আমার দাদা, রক্তিম | হ্যাঁ এখানেই তো উঠেছি | চারতলায় আছি আমরা ৩ আর ৪ নং রুমে | আপনারা?”

“আমরা পাঁচতলার ১ নং ও ৩ নং রুমে আছি | তোমাদের বাড়ি কোথায়?”

“আমরা এসেছি কলকাতা থেকে|”

“আমরাও কলকাতা থেকেই |”

এবার রিকি প্রশ্ন করলো “আপনারা বুঝি দুই বন্ধু একসাথে এসেছেন?”

“হ্যাঁ তাই এসেছি | অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি ভাবলাম ঘুরেই আসি |এদিকটা বহুদিন আসাও হয়নি| তা এই আমার বন্ধুই বললো বিষ্ণুপুর যাওয়ার কথা | তাই এলাম আর কি |”

“ও আচ্ছা | তা আপনারা এখানে যে খুন হয়েছে সেটা খবর পেয়েছেন তো? আপনারা তো সেইদিন সকালে আমাদের পিছনের গাড়িতেই ছিলেন দেখলাম|”

এবার দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি ছবি আঁকা থামিয়ে গম্ভীর গলায় কথা বললো ” হ্যাঁ পেয়েছি | খুব বাজে ব্যাপার | পুলিশ তো বললো মার্ডার কেস | হয়তো কারুর সাথে শত্রুতা ছিল | এসব ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো |”

“ঠিকই বলেছো সমরেশ | বেশি কাদা ঘেঁটে লাভ নেই | আর তোমার বাচ্চা এসব নিয়ে বেশি আলোচনা করোনা |”

“ঠিক আছে | আচ্ছা জেঠু তুমি বুঝি এসে থেকে আরো ছবি এঁকেছো? আমিও একটু-আধটু আঁকি |”

“হ্যাঁ তা এঁকেছি |” বললেন সমরেশবাবু “আমি মেইনলি নেচারের উপরেই স্কেচ করি|”

“সময় পেলে আমরা কখনো দেখতে যাবো তোমার আঁকা জেঠু |”

সমরেশবাবু কোনো উত্তর দিলেন না, মুখ ঘুরিয়ে আঁকায় মনোনিবেশ করলেন| অপর বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন “হ্যাঁ তাই এস| তোমাদের জেঠিমা আর দাদার সাথেও আলাপ করে যেও|যদি আমি না থাকি তাহলে ঘরে এসে বোলো যে নিখিল জেঠু আসতে বলেছিলো কেমন?”

“আচ্ছা চলি এবার আমরা |” এই বলে রিকি আর মোহর ফিরেএল |আসতে আসতে মোহর বললো “নিখিলজেঠুর সাথে কথা বলে বেশ ভালোই মনেহলো| আর সমরেশজেঠু কিরম গম্ভীর প্রকৃতির| মনেহলো আমাদের পছন্দ করছেনা|”

“অনেকে কোনো কাজে ভালোকরে মন দিতে না পারলে, বা চিন্তিত থাকলে এরম গম্ভীর থাকে| একদিন সব ছবিগুলো দেখতে যাবো বুঝলি?”

সেদিন সন্ধাবেলাটা ওদের আড্ডা দিয়েই কাটলো | রাত আটটা নাগাদ রিকি আর বিমানকাকু ঠিক করলো একবার দোতলায় যাবে রমেশ আর সবিতা দাসের সাথে কথা বলতে | লিফটে করে দোতলায় গিয়ে ওরা দেখা করলো| স্বামী-স্ত্রী ঘরেই ছিলেন|বিমানকাকু নিজের পরিচয় দিতেই রমেশবাবু বললো “পুলিশকে তো সব জানিয়েই এলাম| এর মধ্যে আবার মিডিয়ার ঢোকার কি প্রয়োজন?”

“জাস্ট আমাদের কাজ করছি স্যার |” বললো বিমানকাকু “আমি জন-সমাচার পত্রিকার সাংবাদিক| আর এ হলো রক্তিম, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট|”

“বুঝলাম| তা বলুন আপনারা কি জানতে চান|”

“প্রথমেই কাজের কথায় আসি| সবিতাদেবী আপনার কাছে আপনার দূর-সম্পর্কের ভাই কিশোরবাবু কিজন্যে টাকা ধার চেয়েছিলো?”

সবিতাদেবী উত্তর দিলেন “ওর ব্যবসাটা তেমন ভালো চলছিলোনা | আগেও ধার দিয়েছিলাম, ফেরত পাইনি|”

“আপনাদেরতো সম্পর্ক ভালোই ছিল| তাহলে হঠাৎ করে অস্বীকার করেন কেন টাকা দিতে? কিছু ঘটেছিলো?

“আর কত দেব বলুন তো? আমাদেরতো সংসার চালাতে হবে নাকি? আর এবারের টাকার অঙ্কটাও অনেকটা বেশি ছিল| আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা|”

রিকি লক্ষ্য করলো রমেশবাবু যেন কিছু একটা ভাবছেন, কিন্তু মুখে বলতে পারছেন না| তখন ও রমেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা রমেশবাবু, আপনার সাথে কি কিশোরবাবু এখানে আসার আগে যোগাযোগ করেছিল?”

“ক-কই নাতো!” রমেশবাবু যেন চমকে উঠলেন| এটা রিকির চোখ এড়ালোনা | 

“আচ্ছা| আপনাদের যাযা ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে, সব কি আপনিই সামলান?”

“হ্যাঁ বেশিরভাগ সময়তেই আমি সামলাই|”

“আচ্ছা|কিশোরবাবুর সাথে কি আপনার কোনো জয়েন্ট একাউন্ট আছে?”

রমেশবাবু একটা ঢোক গিললো |তারপর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন “না সেরম কিছু নেই |”

রিকিরা উঠে পড়লো | যাবার সময় সবিতাদেবী জিজ্ঞাসা করলো  “এগুলো কি আপনারা ছাপাবেন পেপারে?”

“এখনই না” বললো বিমানকাকু “কলকাতায় ফিরে তারপর দেখবো|”

ঘরে ফিরতে ফিরতে বিমানকাকু রিকিকে বললো “তোর আসল পরিচয় ওদের সামনে দেওয়া গেলোনা| যদি শুনতো যে গোয়েন্দা নিয়ে ঘুরছি, তাহলে আর কথাই বলতোনা|”

রিকি বললো “সে ঠিক আছে,ভালোই করেছো| আমি ভাবছি অন্য কথা |কিছু একটা জিনিস যেন খটকা লাগলো|”

“কি কথা? হ্যাঁ রমেশবাবু নিজের স্ত্রীর আর আমাদের কাছ থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে, সেটাই তো?”

“সেটা তো বটেই,কিন্তু এটা অন্য ব্যাপার| কিযে জিনিসটা ধরতে পারছিনা|”

লিফটের সামনে গিয়ে রিকি বললো “কাকু তুমি উপরে যাও| আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি | গিয়ে একবার পুলিশকে ফোন করো| করে দেখো কিছু খবর পেলে কিনা| আর একবার কলকাতায় প্রদীপকাকুকে ফোন করো |বলো যে রমেশবাবুর সব ব্যাঙ্ক একাউন্ট এর ডিটেলস চাই| সাথে সাথে কিশোরবাবুর বাড়ি তল্লাশি করে যাযা দরকারি কাগজপত্র আর যেযে ছবি পাওয়া গেছে, সেগুলো জোগাড় করে আমাকে পাঠাতে বলো| ওনার মামা এবং আগের ব্যবসার ব্যাপারেও যদি কিছু জানা যায় তাও জানাতে বলো|”

কাকু উপরে চলেগেলো| প্রায় ১৫ মিনিট পর ঘরে ফিরলো রিকি| জিজ্ঞাসা করলো “কিকি জানতে পারলে?”

“কলকাতায় ফোন করে প্রদীপকে খবর নিতে বলেছি| কালকের মধ্যে সব জেনে জাবি| এখানে পুলিশকে ফোন করে একটা নতুন খবর পেয়েছি|কিশোরবাবুর বর্তমান বিজনেসের একটা পার্টনার ছিল| রমাকান্ত যাদব | গতকাল তিনি খবর পেয়েই এসেছেন পুরুলিয়া| পুলিশ ওনার সাথে এবং উপরের দুই বুড়োর সাথে কাল কথা বলবে| তখনি কিছু জানা যাবে|”

সেদিন রাতে মোহর আর বিমানকাকুর জোরাজুরিতে সবার লুচি আর মাংস খাওয়া হলো| ঘরে ফিরে মোহর রিকিকে জিজ্ঞাসা করলো “কিরে কিছু জানতে পারলি?”

রিকি জিজ্ঞাসা করলো “কোন ব্যাপারে?”

“কিশোরবাবুর খুনির ব্যাপারে?”

“কই আমিতো এব্যাপারে কোনো তদন্তও করছিনা, আর কোনো খোঁজ খবরও রাখছিনা!”

“আবার মিথ্যে কথা! তুই কি ভাবছিস আমি জানিনা? আমি দেখছিতো তুই আর কাকু কিসব আলোচনা করছিস মাঝে মাঝে| হ্যাঁরে, তোর মনেহয় খুনি এখানে উঠেছে?”

“জানিনা রে| কলকাতা থেকে কিশোরবাবুর আবার একজন পার্টনার এসেছে|কালকে দেখি যদি কিছু জানতে পারি?”

“জেনে আমাকে জানাবি তো? প্রমিস আমি মাকে কিছু বলবোনা|”

“আচ্ছা রে তাই| এখন চল শুয়েপড়ি | কাল আবার সকালে দলমা পাহাড় দেখতে যাবো!”

      **********************

পরেরদিন সকালে রিকিরা বেরোলো দলমা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য আর ডিমনা লেক দেখতে | দুপুর করে ওখানে পৌছালো ওরা| ঘোরা ভালোই হলো |অভয়ারণ্যে অনেক হাতি দেখলো ওরা।আর ডিমনা হ্রদও খুব সুন্দর । দুপুরবেলা মাকে আর কাকিমাকে খাবারের অর্ডার দিতে বলে রিকি আর মোহর বিমানকাকুকে ধরলো |মোহর বললো “কাকু একবার পুলিশদের ফোন করো|”

“হ্যাঁ এখনই ভালো সময় |দেখি কিছু জানা যায় কিনা|”

প্রায় ১০ মিনিট কথা বলার পর কাকু ফোন রাখলো | রিকিদের বললো “শোন পুলিশ আজ নিখিলবাবু আর সমরেশবাবুর সাথে থানায় ডেকে কথা বলেছে | দুজনেই বলেছে যে কিশোরবাবুর ব্যাবসায়ে দুজনে প্রতারিত হলেও, কেউই ওনাকে পার্সোনালি চিনতেননা |ওদের কথা অনুযায়ী ওরা কখনো কিশোরবাবুর মুখও দেখেননি| খুন করা তো দূরের কথা।”

রিকি বললো “আচ্ছা। আর কিশোরবাবুর পার্টনার কি বললো?”

“কিশোরবাবুর পার্টনার অজয় কুমার গেছিলো পুলিশের কাছে ।দুঃখ প্রকাশ করেছে কিছুক্ষন। আর ওই চিটফান্ডের ব্যাপারেও কথা বলেছে পুলিশ। ও জানিয়েছে সবটাকা কয়েকমাসের মধ্যে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে।”

“হুম। কিশোরবাবু আর অজয়বাবুর মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছিল কি?”

“নাহ । সেরম কিছুও হয়নি বলেই জানালো পুলিশ ।”

“প্রদীপকাকুর সাথে কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ হয়েছে। তোর হোয়াটসআপে সব ছবি আজ রাতের মধ্যে পাঠাবে প্রদীপ।”

কথা বলতে বলতে ওরা খাবার টেবিলে ফিরে এলো । এসে শুনলো পাপিয়া কাকিমা বলছে “দেখতে দেখতেই ছুটি শেষ।কাল ঘুরেই পরশু ফেরা।একদম ভালো লাগছেনা।”

রিকি-মোহরের মা বললো “যা বলেছিস । এতদিন পর ঘুরতে এলাম। ফিরেই আবার স্কুল। ভাবলেই মনমরা হয়ে যাচ্ছি।”

রিকি বললো “তা আরো একদিন থেকেই গেলে পারতে!”

মোহর বললো “না না । ফিরে গিয়ে নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করতে হবে তো!”

দুপুরে খেয়েদেয়ে ফেরার পথে চান্ডিল ড্যাম দেখে রিকিদের হোটেল ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলো। রাতে খাবারের আগে কাকুর ঘরে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো।এমন সময় রিকির ফোনে সবগুলো ফটো ঢুকলো ।রিকি নিজের ঘরে ফিরে এলো।মন দিয়ে সব ছবি গুলো দেখলো।কিছুক্ষন পরে ঘরে মোহর আর বিমানকাকু ঢুকলো। কাকু বললো ” মন দিয়ে কি দেখছিস ফোনে এতো? প্রদীপ কিছু পাঠালো?”

“হুম।” বললো রিকি “তোমরা দেখতে চাও তো দেখো।”

খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ছবি নেই। খালি ব্যবসায়িক কিছু কাগজপত্র আর কোম্পানির কর্মচারীদের কিছু ছবি। মোহর আর বিমানকাকু খুব ভালো করে দেখলো । কাকু বললো ” দুইরকম ব্যবসাতেইতো দেখছি টাকাপয়সার নয়-ছয় হয়েছে।”

রিকি বললো “হ্যাঁ সেতো দেখলুম। আর কিছু দেখতে পেলে?”

“আগের যে মশলার ব্যবসা ছিল, তাতে বেশ কিছু কাগজপত্র মনে হচ্ছে জাল।কোম্পানির কোনো লোগো ছাড়াই আর দরকারি ডকুমেন্টস ছাড়াই মশলার রপ্তানি হয়েছে।”

“আর কিছু? কোম্পানির সব কর্মচারীদের মধ্যে কিছু দেখলে?”

“কি নাতো! আর দুটো ব্যবসার কোনো কর্মচারীকেই সিমিলার দেখলামনা। কেন তুই কিছু ধরতে পারলি?”

“একটা জিনিস পেয়েছি!” মোহর বলে উঠলো “মশলার ব্যবসায়ে তিনজন অংশীদার ছিল। একজন হলো কিশোর চৌধুরী, বর্তমান ঘটনার ভিক্টিম। দ্বিতীয়জন হলো চিন্তামণি বর্মন, কিশোরবাবুর মামা, যে ৯-১০ বছর আগে কোনো এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আর একজনের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। খালি সইয়ের জায়গায় K.C.B লেখা আছে।”

“সাইলেন্ট পার্টনার” এবার রিকি বললো “একদম ঠিক ধরেছিস।এই ভদ্রলোকের কোথাও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।সবজায়গায় সইও নেই।এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে।কাকু একবার প্রদীপকাকুকে ফোন করো ।করে আমাকে দাও। ততক্ষন আমি একটু গ্রুপ ফটোটা দেখি।”

কিছুক্ষন ফোন বাজার পর প্রদীপ কাকু ফোন ধরলো “হ্যালো বিমান?”

“না কাকু রিকি বলছি।”

“হ্যাঁ রিকি বল। সব ছবিগুলো পেয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ কাকু পেয়েছি। তোমাকে আরো দুটো কাজ করতে হবে।”

“হ্যাঁ বল।”

“তোমাকে কিশোরবাবুর ১০-১২ বছর আগের মশলার ব্যবসার যেসকল কর্মচারী ছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কয়েকটা প্রশ্ন আছে সেটা তোমাকে লিখে পাঠাচ্ছি।”

“সবাইকেতো পাবনা। তবে হ্যাঁ যতজনকে পাই,তাদের জিজ্ঞাসা করেনেব। এটা কিন্তু সময়-সাপেক্ষ।”

“চেষ্টা করো কালকে রাতের মধ্যে দেবার। আমরা তো কাল ফিরছি।”

“দেখছি যতটা সম্ভব।আর বল কি লাগবে?”

“কিশোরবাবুর মামা চিন্তামণি বর্মনের মৃত্যু কবে আর কিভাবে হয়েছিল একটু খবর নাও|”

“আচ্ছা। এটা হয়তো কালকেই বলতে পারবো।কিন্তু বাকিটা জানিনা কতটা কি জানতে পারবো।”

“যে কেউ হলেই হবে। কর্মচারীদের না পাও, সিকিউরিটি গার্ড বা পিয়ন যাদের পাও,তাদেরই জিজ্ঞাসা করো।”

“ওকে। তোরা কিরম ঘুরছিস?”

“হ্যাঁ সে ভালোই ঘুরেছি এইকদিন।কাল বিষ্ণুপুর ঘুরে পরশু বেরোবো সকালে।”

“ঠিক আছে।”

“এবার রাখছি। একটু পরেই খেতে যাবো। কালকে জানিও যাযা জানতে পারলে।”

ফোন রাখতেই ওদের খাবারের ডাক পড়লো। নিচে নামলো ওরা খেতে। সেদিনেই মেনু রুটি আর মুরগির কারী। রিসেপশনে গিয়ে দেখে অন্য একজন বোর্ডারের সাথে ম্যানেজার মধুবাবু হাউমাউ করে কথা বলছেন। রিকিরা সামনাসামনি এগোতেই ভদ্রলোক বিমানকাকুর উদ্দেশ্যে বললেন “কি সমস্যা বলুন তো! আমার হোটেলেই পুলিশ আসতে হলো! আমার একটা রেপুটেশনের ব্যাপার আছে তো! “

হঠাৎ রিকি বলে উঠলো “মা, কাকু -তোমরা কথা বলো, আমি একটু উপরে যাচ্ছি “তারপর ও লিফটের দিকে চলে গেল।

বিপাশা জিজ্ঞাসা করলো মধুবাবুকে “তা ওনাদের সাথে কথা বলেছেন এব্যাপারে? আর পুলিশ এসে ওনাদের থানায় ডেকে নিয়ে গেছে।এতে আপনার হোটেলের কেন বদনাম হবে?কোনো সমস্যা তো নেই?”

“আছে ম্যাডাম আছে।কাল যদি এনারাই কিছু করে থাকেন, পুলিশ তো আমাকে ধরবে! আমিও এদের জানিয়ে দিয়েছি, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যেই ঘর ছাড়তে হবে।”

বিমানকাকু প্রশ্ন করলো “কাল সকালে ওনারা আছেন তো?”

“হ্যাঁ তা আছেন । দুপুরের পর ছাড়বে আশাকরি।”

“আপনার কাছে আরো একটা প্রশ্ন আছে। বলছি আমাদের রুমগুলো কি ৩০ তারিখের পর আর বুকিং আছে? একদিন যদি বেশি থাকি, মানে ৩১ তারিখটা থেকে ১ তারিখ সকালে বেরোলাম, অসুবিধা হবেনা তো?”

বিদিশা আর পাপিয়া কাকিমা তো অবাক। মধুবাবু একটু ভেবে বললেন “না যতদূর আমার মনে পড়ছে কোনো বুকিং নেই। থাকতেই পারেন অসুবিধা হবেনা।”

কাকিমা বললো “হঠাৎ করে আবার একদিন থাকতে যাবো কেন? এটা আবার কখন ঠিক হলো? মোহর জানতিস?”

মোহর বললো “হ্যাঁ একটু আগেই ঠিক হলো আর কি, এখনো তো কনফার্ম করছিনা কিছু ।কালকেটা দেখা যাক।এখন সবাই উপরে চলো।”

ওরা ঘরে ফিরে দেখে রিকি চুপচাপ বসে আছে। তার দৃষ্টি ফোনের দিকে। মুখে বাঁকা হাসি।বিপাশা বললো “হ্যাঁরে রিকি, এসব নিশ্চই ওই কেসটা রিলেটেড।কি ব্যাপার বলতো? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

চোখ থেকে চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে রিকি বললো “আসলে এতদিন আমার ব্যাপারটা অতটা গুরুতর লাগেনি।কিন্তু একদিন আমি আর কাকু এব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম।এখন দেখছি কেসটা যতটা সোজা ভেবেছিলাম, ততটাও নয়।কিন্তু আরো কয়েকটা জিনিস জানার বাকি।সেটা মনেহয়না কালকের মধ্যেই জানতে পারবো।একদিন সময় লাগতে পারে। কলকাতায় প্রদীপকাকু খোঁজ লাগিয়েছে, খবর পাঠাবে আমাকে।জানি তোমরা চাও যাতে আমি এসব ব্যাপার থেকে দূরে থাকি,কিন্তু আমি কিছু না করলে অপরাধী ছাড়া পেয়েযাবে।”

পাপিয়া কাকিমা বললো “কিন্তু এসব ব্যাপারতো পুলিশকেই জানালে হয়।আর যাইহোক তুই ছোট, কোথায় কে কি করবে।”

“কিচ্ছু হবেনা। আমি বেপরোয়া এমন কিছু করবোনা। আর আমার সাথে বিমানকাকু থাকছেইতো সবসময়।আর পুলিশ এব্যাপারে তদন্ত করতে না করতেই পাখি পালিয়ে যাবে।”

এই বলে রিকি ওর মা, কাকিমা আর মোহরকে সব ডিটেলস জানালো।

বিমানকাকু বললো “রিকি, রুমদুটো আমরা আরো একদিন পেয়েযাবো।কথা বলেনিয়েছি।কিন্তু কালকে সন্ধ্যার মধ্যে যারা এই কেসের সাসপেক্ট,তাদের ঘর ছেড়ে দিতে বলেছেন ম্যানেজার বাবু।”

রিকি একপেশে একটা হাসি হাসলো “সেটাইতো স্বাভাবিক। তাহলে কাল সকালে একবার গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এবার আসল পরিচয়ই দিতে হবে যা দেখছি।”

একটু পরেই যে যার ঘরে শুতে চলে গেল । যাবার সময় কাকু মোহরকে জিজ্ঞাসা করলো “তোর দাদা কি ভাবছে কিছু বুঝলি?”

“হ্যাঁ বুঝেছি।” বললো মোহর “হাতে হয়তো প্রমান নেই, কিন্তু দাদা খুনিকে শনাক্ত করেফেলেছে।”

বিমানকাকু অবাক হয়ে বললো “কিকরে বুঝলি?”

“আমার দাদাকে চেনা আছে।যখনি কিছু ধরতে পারে, ও অন্যরকমভাবে হাসে।”

“বুঝলাম। তোরা সাবধানে থাকিস কেমন?” এই বলে বিমানকাকু ঘরে ফিরলো।মোহরও নিজের রুমে ফিরে গেল।

    ************************

“আচ্ছা এটা দেখতো ঠিক-ঠাক লিখেছি কিনা।” রিকির দিকে একটা খাতা বাড়িয়ে দিল মোহর।

“কি লিখেছিস এখানে?” রিকি জিজ্ঞাসা করলো।

“এই কেসের কিছু নোটস আর সাসপেক্ট-লিস্ট।”

“কিন্তু তুইতো তোর নোটস লেখার খাতা আনিসনি এখানে। এটা কিকরে পেলি?”

“কাকু কিনেদিল আজ সকালে।তাতেই লিখেছি।”

আজ ৩০ তারিখ। সকালবেলাতেই টিফিন খেয়ে ঘরে বসেছিল রিকি আর মোহর। মা আর কাকু-কাকিমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বিষ্ণুপুরের যাযা দেখার জায়গা আছে দেখতে।মোহরও যেত,কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওর কি মনে হওয়ায় থেকে গেল রিকির সাথে।রিকি খাতাটা মন দিয়ে পড়তে লাগলো-

মৃত ব্যাক্তির নাম-কিশোর চৌধুরী

কিভাবে মারা হয়েছে-গলা টিপে শ্বাসরোধ করে।

যাদের সন্দেহ হয়-

১. সবিতা দাস-রমেশ দাস- ভিকটিমের দূর-সম্পর্কের দিদি-জামাইবাবু।সম্পর্ক ভালোনা।টাকা-পয়সা ছাড়া যোগাযোগ নেই। শেষবার টাকা দেয়নি ভিকটিমকে।তার জন্যে খুন?

২. নিখিল চক্রবর্তী- ভিকটিমের কোম্পানি দ্বারা প্রতারিত। তার জেরেই খুন? ভিকটিমকে চিনতোনা বলেছে। 

   আদৌ সত্যি?

৩. সমরেশ পাল- নিখিলবাবুর সাথে সমান মোটিভ।হাব-ভাব সন্দেহজনক।

৪. অজয় কুমার- ভিকটিমের পার্টনার।কোনো সমস্যা হয়নি বলেই দাবি। আদৌ সত্যি? টাকার জন্যে খুন? সন্দেহজনক জামাইবাবু।

এই কেসে ভিকটিমের মামা আর আগের কোম্পানির কোনো কর্মচারীর যোগসূত্র আছে কি? K.C.B  কে? মামার মৃত্যু স্বাভাবিক? বদলা নিতে খুন?

“হুম, মোটামুটি ঠিক আছে।তবে আরো কয়েকটা জিনিস লিখিসনি।”রিকি বললো।

“কিকি লিখিনি বল?”

“সেসব তোর জানারও কথা নয়। তবে একজনকে বাদ দিয়েছিস।সেটা হলো নিখিলবাবুর ছেলে।”

“তাকে ধরেই বা কি করবো? আর মোটিভ কি?”

“বাবাকে যে ঠকিয়েছে,তাকে রাগের মাথায় খুন।বাড়ির সব টাকা-পয়সা যে কেড়ে নিয়েছে,তার প্রতি সব সদস্যেরই তো রাগ থাকতে পারে।”

“এটা চিন্তা করিনি।দাঁড়া লিখেনি।”

“এখুনি লিখিসনা। একবার আমার সাথে চল পাঁচতলায়।কথা বলে আসি।”

দুজনে মিলে লিফটে করে গেল পাঁচতলায়।ওরা প্রথমে গেল সমরেশবাবুর ঘরে। ভদ্রলোক ঘরেই ছিলেন, বসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলেন আর আঁকছিলেন।। রিকি বললো “জেঠু তোমার আঁকা ছবি দেখতে এসেছি।”

সমরেশবাবু ওদের বসতে বলে কয়েকটা পেপার আর খাতা বের করলেন। রিকি আর মোহর ওগুলো দেখতে লাগলো।রিকি একটু পরে জিজ্ঞাসা করলো “জেঠু তোমরা আর কদিন আছো?”

“আজকেই বেরোবো দুপুরবেলা” বললো সমরেশবাবু “তোমরা এখন আছো তো?”

“হ্যাঁ।আপনারা কি ওই কেসের ব্যাপারে হোটেল ছেড়ে দিচ্ছেন? আপনাদের তো পুলিশ তলব করেছিল।”

চমকে উঠলেন সমরেশবাবু। ওদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন “তোমরা এসব কথা জানলে কিকরে, কে বলেছে তোমাদের ?”

“কেউনা” বললো রিকি “আমরা নিজেরাই খোঁজ নিয়ে জেনেছি।আসলে আমাদের বাবা পুলিশে ছিলেন।ওনার থেকেই বোধহয় ,ছোটবেলা থেকেই এসব ব্যাপারে আমার একটু ‘ন্যাক’ আছে।তাই কোথাও গন্ডগোল দেখলে ,তার সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করি।এব্যাপারে আমার মনেহচ্ছে আপনি কিছু একটা লুকোচ্ছেন।”

নিজের সব পেপার, আঁকা নিয়ে গুছিয়ে ব্যাগে পুড়তে পুড়তে রাগত স্বরে সমরেশবাবু বললেন “এখানে ডিটেকটিভ-ডিটেকটিভ খেলা হচ্ছে? বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হয়ে এসব ব্যাপারে নাক গলাবেনা! এব্যাপারে তোমাদের সাথে একটাও কথা বলবোনা আমি! যা বলার পুলিশের সাথে হয়েগেছে।তোমরা এস|”

রিকি উঠে দাঁড়িয়ে বললো “কিশোরবাবুকে আপনি চিনতেন, তাইনা? আপনি ওনাকেই ফলো করে এখানে এসেছেন তাইনা?”

উত্তর দিলেন না সমরেশবাবু ।ওদেরদিক থেকে পিছন ঘুরে কাজ করতে লাগলেন।

রিকি বললো “আমাদের নাই বলুন, পুলিশকে তো বলতেই হবে।আর এই মুহূর্তে আপনারা কোথাও যেতেও পারবেন না ।১ তারিখ অব্দি এখানেই থাকতে হবে।পুলিশ তো জায়গা ছাড়তে বারণ করেছে আপনাদের নিশ্চই।এখন আমরা আসছি,কিন্তু খুব শীঘ্রই দেখা হবে।”

রিকি মোহরকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মোহর জিজ্ঞাসা করলো “এবার কি নিখিল জেঠুর ঘর?”

রিকি বললো “হুম। ২ মিনিট কথা বলে চলে এসব। এখানে এসেছিলাম বলার দরকার নেই।”

নিখিলবাবুও ঘরেই ছিল। উনি রিকি আর মোহরকে খুব খাতির করলেন, নিজের স্ত্রী রিনিতা আর ছেলে অখিলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন।রিনিতাদেবী ওদের সাথে ভালোভাবে কথা বললেও, অখিল চুপচাপ বসে রইলো।অখিলের গড়ন রোগা লম্বা।গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে।নিখিলবাবুকে রিকি জিজ্ঞাসা করলো “আপনারা এখানে আছেন তো কদিন?”

নিখিলবাবু বললেন “হ্যাঁ সে আছি।একটু কাজ পড়েছে আমাদের। সেটা মিটিয়ে যাবো।”

কিছুক্ষন ওদের সাথে কথা বলে ঘর থেকে বেরোলো রিকি-মোহর। মোহর বললো “আচ্ছা এবার আমি খাতায় লিখেনি অখিলবাবুর নাম?”

“লিখতেও পারিস” বললো রিকি “কিন্তু আমার মনেহয়না তেমন কিছু লাভ হবে বলে।যা চেহারা আর হাবভাব দেখলাম, মনেহয়না রাগের মাথায় ভারী চেহারার কিশোরবাবুর গলা টিপে মারবে বলে।”

লিফটে ঢুকে রিকি মোহরকে বললো “শোন তুই একবার এক তলায় যা। গিয়ে দেখ সিন্টুদা আর ম্যানেজারবাবু কোথায় আছে।কিছুক্ষন কথা বল সিন্টুদার সাথে।ওদের না দেখলে ফোন মেসেজ করিস। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছি। একবার ঘরে যেতে হবে।”

মোহর একতলায় নেমে দেখলো ম্যানেজার মধুবাবু বাইরে কাদের সাথে যেন কথা বলছেন।সিন্টুদা রিসেপশনে বসে। ও গিয়ে বললো “দাদা কি করছো?”

সিন্টু বললো “হেঁ হেঁ, ইতো একটু বসেই আছি।স্যার ব্যাস্ত তো!”

“হ্যাঁ তাইতো দেখছি। আচ্ছা আজ দুপুরে কি খাবো,সেটা অর্ডার দিয়েযাবো”

“হেঁ হেঁ ঠিক আছে। এই নিন মেনু কার্ড।”

দুপুরের পোলাও আর কষা মাংস অর্ডার দিয়ে মোহর জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা দাদা এখানে হাতি দেখেছো কোনোদিন?” 

“হেঁ হেঁ তা দেখবনা? কয়েকবার দেখেছি। আর মাঝে মাঝে তো গ্রামেও ঢুকে আসে হাতি হেঁ হেঁ।”

এমন সময় রিকি নিচে নেমে আসে। মোহরকে বলে “চল উপরে চলে যাই।”

ঘরে যেতেই প্রদীপকাকুর ফোন: “হ্যালো রিকি?”

“হ্যাঁ কাকু বোলো।”

“কটা খোঁজ নিলাম, কিন্তু সব পাইনি। এতোক্ষনের মধ্যে খুঁজে খুঁজে দুজনের সাথেই কথা বলতে পেরেছি। একজন ছিল পিয়ন আর একজন সাব-স্টাফ। যে প্রশ্নগুলো বলেছিলি, করেছি। রেকর্ডিংটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“আচ্ছা, K.C.B এর ব্যাপারে কি বললো?”

“যে পিয়ন সে কিছু বলতে পারেনি।আর যে স্টাফ, তার মতে K.C.B বলে আসলে কেউ নেই।আসলে কিশোরবাবুর নাম সংক্ষেপে হলো K.C আর চিন্তামণি বাবুর ক্ষেত্রে C.B। ওদুটো নামকেই জোড়া লাগিয়ে হচ্ছে K.C.B।”

“আচ্ছা, আর চিন্তামণি বাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জানলে?”

“হ্যাঁ। মারা যাবার আগে উনি একটা বড়ো কাজে হাত দিয়েছিলেন।অনেক টাকা-পয়সা জড়িয়েছিল।কিন্তু ডিল ফাইনাল করতে উনি একাই গেছিলেন। কিশোরবাবুকেও সঙ্গে নেননি। এই কাজে নাকি কারুর মত ছিলোনা।কর্মচারীরা অনেকেই বেঁকে বসেছিলেন। অনেকেরই সন্দেহ ছিল, কোনো অবৈধ কাজের জন্যেই যাচ্ছিলেন চিন্তামণিবাবু। ওদের খাজাঞ্চি বাঁড়ুজ্জে মশাই নাকি আবার ওনার কুষ্ঠিবিচার করে বলেছিলো এ যাত্রায় ফাঁড়া আছে। কিন্তু উনি শোনেননি।”

“আচ্ছা আরো কয়েকজনকে যদি পাও তো দেখো।চিন্তামণি বাবুর সম্পর্কে আরো একটু ডিটেলস জানার চেষ্টা করো।আর রেডি থেকো, কাল আসতে হতে পারে এখানে।এখন রাখছি।একবার এখানে পুলিশকে জানিয়েদিও, কেসের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা যেন বিষ্ণুপুর ছেড়ে না যায় এখনো।”

                                                                  ***********************

প্রদীপকাকুর সাথে কথা বলার পর কাকুর পাঠানো রেকর্ডিংটা শুনলো মন দিয়ে। রিকি-মোহরের মা আর কাকু-কাকিমা ফিরতে কাকুর সাথে অজয়বাবুর সাথে দেখা করতে গেল রিকি।কিশোরবাবুর গেস্ট হাউসেই উঠেছেন অজয়বাবু। লম্বা চওড়া চেহারার রাশভারী ভদ্রলোক। খুব বিরক্ত ভাবেই কথা বলতে বসলেন উনি “পুলিশকে আমি সব ইনফরমেশন দিয়েছি। আবার কি দরকার?”

বিমানকাকু বললো “আসলে আমরা একটু নিজেদের দিক থেকে তদন্ত করছি।কয়েকটি প্রশ্ন করবো।”

“আচ্ছা করুন।”

“কিশোরবাবু এখানে এসেছিলেন, আপনাকে বলেছিলেন তো?”

“ইয়েস। আমাকেও আসতে বলেছিলো। বাট বিজনেস দেখার জন্যে একজনকে কলকাতায় থাকতেই হতো।”

“কি জন্যে এসেছিলো আপনাকে বলেছিলো?”

“জাস্ট ফর চেঞ্জ। তবে…”

“তবে কি?”

“এখন বললেন বলে মনে পড়লো, কিশোর যেন বলছিলো কিছু টাকার ব্যবস্থাও হতে পারে। কথাটা আগেও বলেছিলো কয়েকবার, কোনোবারই কিছু করতে পারেনি। এবারে আমি অতটা গুরুত্ব দেইনি, বাট আই থিঙ্ক হি ওয়াস ড্যাম সিওর দিস টাইম!”

“ঠিক আছে, থ্যাংক ইউ । কাল আপনাকে একটু আমাদের হোটেলে আসতে বলতে পারি। যাবেন না যেন কোথাও।”

“হ্যাঁ কদিন থাকতে বলেছে পুলিশ। আই উইল হেল্প ইন এভরি ওয়ে।”

ওখান থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরলো রিকিরা। দুপুরে খেয়ে-দিয়ে ওরা মধুবাবুকে জানিয়ে দিলো যে ওরা আরো একদিন থাকছে।ঘরে ফিরে এসে, বাকিরা গল্প করছিলো। রিকি কিছুক্ষন ফোন ঘাঁটলো, কয়েকবার মোহরের খাতাটা পড়লো।

তারপর নানা কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। সেদিন সন্ধ্যাবেলাটা আর রাতের বেলাটা রিকিরা বিষ্ণুপুরের নানা ফটো দেখে, গল্প শুনে, মা আর কাকু-কাকিমার বিষ্ণুপুরে কিকি দেখলো- এইসব ব্যাপারে গল্পকরেই কাটালো। মাঝে প্রদীপকাকু একবার ফোন করেছিল রিকিকে। কিছুক্ষন কথা হয়েছে।মোহর রিকিকে বললো “হ্যাঁ রে ,সবতো জেনে গেছিস । আমাকেও একটু বলনা।”

“কে বললো সব জেনেগেছি?”

“তোর ঘন ঘন ফোন করা দেখে আর তোর হাবে-ভাবে মনে হচ্ছে আমার।”

“না সব জানতে পারিনি “চোখের চশমাটা ঠিক করে পড়লো রিকি “কিন্তু হ্যাঁ একটা ধারণা পেয়েছি।এখনই কিছু বলা যাবেনা।কাল প্রদীপকাকু আসবে কলকাতা থেকে, সাথে আরো পুলিশ থাকবে। কটা প্রমান পাওয়া বাকি। কালকেই জানা যাবে।”

“আচ্ছা একটু ক্লু তো দে!”

“আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দে, ঠিক দিলে কিছুটা বলবো।”

“কি প্রশ্ন?”

“৮:৮,৮:৮, ১৬:১৬,৮:৮ -এই সিরিজটা কিকরে সম্ভব?কিকরে সব অনুপাত সমান করাযাবে?”

“এটাতো কোনো সিরিজই হলোনা! ৮:৮ হতে হতে ১৬ কিকরে হয়? পারবোনা আমি!তুই আমাকে এমনিই বল।”

“উহু! এখনই বলা যাবেনা।সবুর কর,কালকেই জানতে পারবি।”

পরেরদিন সকাল থেকে সবার মনে একটা টেনশন চলতে লাগলো।কলকাতা থেকে পুলিশ আসার কথা রিকি বাড়ির সবাইকে জানিয়েছে কিন্তু আর কাউকে জানাতে বারণ করেছে। মোহর আর বিমানকাকু কে খুনি- এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলো।কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারলোনা।সারাদিনটা বসেই কাটলো সবার। সন্ধেবেলা প্রদীপকাকু ফোন করলো রিকিকে: “আমি ফোর্স নিয়ে যাচ্ছি বিষ্ণুপুর। কাগজপত্র রেডি করতে গিয়ে একটু দেরি হয়েগেলো। আর তুই যাযা খবর নিতে বলি সেগুলোও জানতে দেরি হয়েগেলো। ঢুকতে ঢুকতে রাত ১০ টা বেজে যাবে।”

“ঠিক আছে। আমি এদিকে ব্যবস্থা করে রাখছি।”

রাতের খাওয়া দেওয়ার পর রিকিদের লজে সাদা পোশাকে এলো প্রদীপকাকু,সাথে তিনজন সাদা পোশাকের পুলিশ, কিশোরবাবুর পার্টনার অজয় কুমার,নিখিলবাবু, সমরেশবাবু , রমেশবাবু আর সবিতাদেবী।সবাইকে রিকিদের ঘরে বসালোবিমানকাকু। বিদিশা আর পাপিয়া কাকিমাকে আগেই অন্য ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।সবাই অসন্তুষ্ট। প্রদীপকাকু সবাইকে নানাভাবে বোঝাতে থাকলো।তারপর রিকি উঠে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করলো ।

“সবাইকে এইসময়ে বিরক্ত করার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু কয়েকটা কথা আলোচনা করার জন্যে এই অসময়ে সবাইকে ডাকলাম। আগে আমার পরিচয় দেয়। আমার নাম রক্তিম সরকার। পরিবারের সাথে এসেছিলাম বিষ্ণুপুরে  ছুটি কাটাতে। কিন্তু আমরা আসার ঠিক পরের দিনেই ঠিক পাশের গ্রামে একটা খুন হয়ে যায়। আমরা সর্বপ্রথম বডিটা ডিসকভার করি।আমার ঠাকুর্দা ছিলেন প্রখ্যাত গোয়েন্দা। আমার বাবাও পুলিশে ছিলেন।আমাকেও শখের গোয়েন্দা বলতে পারেন।স্বাভাবিকভাবে এই ব্যাপারে আমি না চাইতেও জড়িয়ে পড়ি। একটা খুন হলো, আর খুনি হয়তো এই লজেই লুকিয়ে-এটা জেনে আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারিনি।”

এমন সময় ঘরে ঢুকলো ম্যানেজার মধুবাবু। বিমানকাকুকে বললো “আপনি একবার আসতে বলেছিলেন আমাকে, কি ব্যাপার? ঘরে এতো লোকজন কোনো? কিছু হয়েছে নাকি?”

“আসুন মধুবাবু” উত্তর দিলো রিকি “এখানে কিছু কথা হচ্ছে যা আপনার শোনার দরকার। তাই আপনাকে আসতে বলা। এবার আমি কিছু কথা বলবো, যদি কিছু ভুল বলি তো ধরিয়ে দেবেন ।”

“আচ্ছা বেশ” হতভম্ব মধুবাবু পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

“হ্যাঁ তো যে কথা বলছিলাম,সে কথায় ফিরে আসি” রিকি বলতে লাগলো “কথা হচ্ছিলো কিশোরবাবুর খুনের। চিটফান্ডের একটা ব্যবসার মালিক কিশোর চৌধুরী বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন ঘুরতে।ঘুরতে এসে তিনি খুন হয়েযান। ওনাকে রাত্রিবেলা মাঠের পাশে একটা ঘন জঙ্গলের কাছে গলা টিপে মারা হয়। অত রাতে অমন ফাঁকা জায়গায় কিশোরবাবু কেন গেছিলেন? হয়তো চেনা কারুর সাথেই দেখা করতে।কিন্তু কেন?”

“এবারে আসি কিশোরবাবুর ব্যবসার কথায়। কয়েক বছর ধরেই ওনার ব্যবসায়ে মন্দা চলছিল। আবার অনেকটাকা দেনাও হয়েগেছিলো। সেইজন্যে উনি নিজের এক দূরসম্পর্কের দিদি আর জামাইবাবুর থেকে অর্থসাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা দিতে রাজি হননা। ঠিক বললাম তো সবিতা দেবী?”

সবিতা দেবী ঘাড় নাড়লেন। রিকি বলতে থাকলো “আচ্ছা আপনারা বেড়াতে আসছেন সেটা আপনারা কিশোরবাবুকে জানাননি। তা সত্ত্বেও উনি বেড়ানোর জন্যে আপনারা যেখানে এলেন সেখানেই আসলেন, এবং কাছাকাছি একটা হোটেলে উঠলেন। এটা কি পুরোটাই কাকতলীয়?”

“সেটা আমরা কি করতে পারি?” ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী “আমরাতো আর জানায়নি এখানে আসছি!”

“আপনি নাও জানাতে পারেন,কিন্তু রমেশবাবু আপনি?” রিকি রমেশবাবুর দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো “আপনিও জানাননি?”

রমেশবাবু চুপ করে রইলেন।ওনার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা গেল।রিকি বললো “কলকাতার পুলিশের থেকে খবর পেয়েছি।কিশোরবাবুর মা জানিয়েছেন যে বেড়াতে যাবার ৩ দিন আগে আপনি গেছিলেন ওনাদের বাড়ি। গিয়ে কিছুক্ষন কথাও বলেছেন।কিজন্যে গেছিলেন রমেশবাবু?”

রমেশবাবু এখনো চুপ। রিকি বললো “আপনি উত্তর না দিলেও, এ ঘরে একজন আছেন, যে এই কথার উত্তরটা জানেন। অজয়বাবু কিছু বলবেন?”

“ওহ নো!” অজয়বাবু বলে উঠলেন “কিশোর ওনার থেকে টাকা নিতে এসেছিলো? ও হয়তো এই কথাই আমাকে বলেছিলো, আমি বিশ্বাসই করিনি! ভাবলাম ব্লাফ করছে!”

“না, মিথ্যে বলেননি কিশোরবাবু” রিকি বললো “খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, রমেশবাবুর ব্যাঙ্ক থেকে একটা বড়ো অঙ্কের টাকা তোলাও হয়েছে।আমার মনেহয়, সবিতাদেবী দিতে না চাইলেও, রমেশবাবু ফেরাতে পারেননি কিশোরবাবুকে। বেড়াতে যাবার খরচের সাথে ওই টাকাটাও উনি রেখেছিলেন কিশোরবাবুকে দেবেন বলে। কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন সব এতো জলদি হয়েযায়, উনি দিতে পারেননি।কিশোরবাবুকে আসতে বলেন এখানে। একদিন দেখা করে দিতেন কিছু টাকা।ঠিক বললাম তো রমেশবাবু?”

এবার রমেশবাবু কথা বললেন “কিশোর আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল। অনেকদিন যোগাযোগ ছিলোনা। সবিতার সাথে বিয়ের পর আবার দেখা হয়।হয়তো কথা-বার্তা হতোনা, কিন্তু ওর এমন একটা অনুরোধ, আমি ফেরাতে পারিনি। সবিতাকে লুকিয়েই ভেবেছিলাম টাকাটা দেব।কিন্তু তার আগেই… “কথা বলতে বলতে ওনার চোখে জল চলে আসে।

“হুম। আর আপনার সাথে দেখা করতে এই লজে এসেছিলো কিশোরবাবু। সেইসময় উনি সমরেশবাবুকেও দেখতে পেয়েযান।”

“আমার সাথে কি সম্পর্ক?” রেগে বলে উঠলেন সমরেশবাবু “দেখো বাপু, আমাদের এসব গন্ডগোলে জড়াবেনা। আমি ওনাকে চিনতামনা!”

“উহু, চিনতেন আপনি কিশোরবাবুকে” রিকি বললো “ওই জন্যেইতো ওনাকে ফলো করে এসেছিলেন এখানে!”

“এসব কি বলছে ও সমরেশ?” নিখিলবাবু জিজ্ঞাসা করলো। সমরেশবাবু রেগে মুখ নিচু করে বসে থাকলেন।

“ঠিকই বলছি নিখিলবাবু।আপনার বন্ধুটি কলকাতায় অনেকবার কিশোরবাবুর কোম্পানিতে গেছেন ওনাকে শাঁসাতে। ভালোভাবেই চিনতেন উনি কিশোরবাবুকে। বেড়াতে আসার খবর পেয়ে উনিও ঠিক করেন এখানে আসবেন। দেখবেন কথা বলে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু আপনিও আসতে রাজি হওয়ায় উনি আপনাকে আর মানা করতে পারেননি।”

নিখিলবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার অতিপরিচিত বন্ধুর মুখের দিকে।

        *************************

ঘরের মধ্যে এক অস্বস্থিকর নিস্তব্ধতা। এবার অজয়বাবু জিজ্ঞাসা করলো “বাট হু ইজ দি মার্ডারার?”

“আপনাদের মধ্যেই একজন” রিকি বললো “মোটিভ সবারই ছিল।কিশোরবাবুর সাথে রমেশবাবুর কথা কাটাকাটি হতে পারে, নিখিলবাবুও হয়তো চিনতেন ওনাকে, রাগের মাথা খুন করেছেন। একই কারণ সমরেশবাবুরও হতে পারে। অন্য কারণও থাকতে পারে। সবিতাদেবী আর রমেশবাবু একসাথেও কাজটা করতে পারেন। আবার আপনিও অজয়বাবু, আপনার সাথেও কিশোরবাবুর সমস্যা থাকতে পারে। সেজন্যে আপনিও একাজ করতে পারেন। কিন্তু এবার আসছি অন্য কথায়।”

“১০ বছর আগের কিশোরবাবুর মশলার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা ছিল। ওনারা ৩ জন পার্টনার ছিলেন, একজন কিশোরবাবু নিজে, একজন ওনার মামা চিন্তামণিবাবু, আর ‘K.C.B’ নামের একজন, যিনি সাইলেন্ট পার্টনার ছিলেন। অর্থাৎ K.C.B সামনে না থেকেও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। ব্যবসার কয়েক বছর পর চিন্তামনিবাবু লক্ষ্য করেন, একটা বিশাল অঙ্কের টাকা নয়-ছয় হচ্ছে। আর মশলার আড়ালে আরো অন্য অবৈধ জিনিস বিদেশে পাচার হচ্ছে। তিনি ঠিক করেন কালপ্রিটকে হাতে-নাতে ধরবেন। একটা বড়ো কাজের ছুতো করে তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যেখান থেকেই মূল পাচার শুরু হয়।”

“কলকাতা থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এই বড়ো কাজটা নিয়ে চিন্তামনিবাবু সুন্দরবন গেছিলেন। দুয়ে-দুয়ে চার করলেই বোঝা যাবে, মশলার আড়ালে বিদেশে বাঘের চামড়া,দাঁত-এইসকল বস্তু পাচার হচ্ছিলো। বিদেশের বাজারে বাঘের জিনিসের দাম কোটি কোটি টাকা। চামড়া দিয়ে জুতো,বেল্ট তৈরী হয়, দাঁত গুঁড়ো করে ওষুধ তৈরী হয়,আবার মদ তৈরিতেও কাজে লাগে। চিন্তামণি বাবু ওনার পার্টনার K.C.B কে সন্দেহ করে,যে কিনা ছিল একজন দক্ষ শিকারী। কাউকে না জানিয়ে শুধু মাত্র ওনাকে নিয়েই গেলেন সুন্দরবন। কিন্তু K.C.B বুঝতে পেরে যায় এটা তাকেই ধরার চাল। কিন্তু না যেতে চাইলে বাকিদের সন্দেহ পড়বে ওনার উপর। তাই সে ঠিক করলো,সুন্দরবনেই শেষ করবেন চিন্তামনিবাবুকে।”

“এক রাত্রিবেলা K.C.B জঙ্গলের মধ্যে গুলি করে মারেন চিন্তামনিবাবুকে। কিন্তু সেটাকে দুর্ঘটনা বলে প্রমান করেন। চারিদিকে রটিয়ে দেন, বাঘের কামড়ে প্রাণ গেছে চিন্তামনিবাবুর। সত্যিটা কি, কেউ জানতে পারলোনা। মুখ বন্ধ করার জন্যে টাকাও ছড়ালেন। তারপরেই ফেরার হয়েযান তিনি। কিন্তু পাপ যেমন পিছু ছাড়েনা, তেমনি প্রায় ১০ বছর পরেও সে কিশোরবাবুর সামনাসামনি আসে। এবং কিশোরবাবু তাকে চিনেও ফেলে। হাজার হোক পুরোনো সহকারী।”

“আমার মনেহয়, নিজের মামার মৃত্যুর ব্যাপারে কিশোরবাবু K.C.B কেই সন্দেহ করতেন। হয়তো কোম্পানির কাগজ-পত্র থেকে এই টাকার নয়-ছয় এর ব্যাপারটাও জানতে পারেন। কিন্তু ততদিনে K.C.B ফেরার। এতদিন পর একে হাতে পেয়ে কিশোরবাবু ব্ল্যাক-মেল্ শুরু করেন। যাইহোক ওনার টাকার দরকার। প্রমাণও আছে, চাইলে পুলিশের কাছে প্রমান করেদেবেন , K.C.B-ই চিন্তামনিবাবুর হত্যাকারী। এদিকে পালানোর পথ নেই। বিপদ থেকে বাঁচতে কিশোরবাবুকে খুন করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিলোনা। এবং করলেনও তাই । এই K.C.B আজ এই ঘরে সবার মধ্যেই বসে আছেন।”

ঘরের সবাই চুপ।এবার রিকি ফোনটা বের করলো। একটা নির্দিষ্ট ফটো খুলে মধুবাবুর দিকে এগিয়ে দিলো ও “আচ্ছা মধুবাবু, এখানে কাউকে চিনতে পারছেন? কারুর মুখ চেনা লাগছে?”

মধুবাবু তোতলাতে শুরু করলেন “আ-আ-আমি কিকরে চিনবো, আমিতো-তো কি-কিছুই জানিনা।”

“আরে দেখুননা” বললো রিকি “দেখুন কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ডানদিক থেকে ৪ নম্বরে যে দাঁড়িয়ে,তাকে চিনতে পারছেন? পারারই কথা, ছবিটাতো আপনারই , তবে অনেকটা কম বয়সের।”

হঠাৎ মধুবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে ছুটলেন। পুলিশরা তৈরীই ছিল।খপ করে ওনাকে ধরে ফেললো।হাতে হাতকরাও পরিয়ে দিলো।জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

“আমি কিছু করিনি!” চেঁচিয়ে উঠলেন মধুবাবু “আমি ওনাকে চিনিনা!”

“চিনতেন কি চিনতেননা এখুনি প্রমান করে দিচ্ছি” বললো রিকি “ছবিটা দেখার পরেই আমার আপনার উপর প্রথম সন্দেহ পরে। যদিও আপনার এখনের চেহারার সাথে আগের চেহারার কোনো মিল নেই, তাও ভালোকরে মুখের দিকে দেখলেই বোঝা যাবে ,এই দুই ব্যক্তিই আসলে একজন। তখন আমি কলকাতার আমার পরিচিত এই পুলিশকাকুর সাথে যোগাযোগ করি, এবং কিশোরবাবুর পুরোনো কোম্পানির কয়েকজন লোক-জনের সাথে কথা বলতে বলি। এই সকল কথার মধ্যে একটা জিনিস খটকা লাগে,বয়ানে এক ব্যক্তি কোনো এক জনৈক “বাঁড়ুজ্জে-মশাই’ -এর উল্লেখ করেন। প্রথমে না বুঝলেও ,পরে খেয়াল করি যে,বাংলা ভাষায় ‘বাঁড়ুজ্জে’ আর ‘ব্যানার্জী’- এইদুটো পদবি সমান। একএকজন এক-এক রকম ভাবে বলে থাকে। এবং এই হোটেলের নামটাও তো ‘ব্যানার্জী-লজ’, তাইনা? এমনকি মধুবাবু নিজেও বলেছিলেন,উনি লজের ম্যানেজার,মালিক নন,মালিক হলেন ‘ব্যানার্জীবাবু’।”

“কিন্তু একই পদবীর লোক তো অনেকজন হতে পারে” বিমানকাকু বললো “তুই কিকরে বুঝলি যে এক্ষেত্রে দুজনেই সমান?”

“প্রথমে বুঝিনি” রিকি বললো “কিন্তু ১০ বছর আগের ঘটনা এবং এই ঘটনায় একই ব্যক্তির উপস্থিতি, এবং একই পদবীর দুজনকে পাওয়ায় মনে হলো একটা কানেকশন থাকতেই পারে। তখনি আমি প্রদীপকাকুকে বলি, কিশোরবাবুর মশলার ব্যবসার সাথে যুক্ত সকল কর্মচারীর নাম বের করতে, সাথে সাথে স্থানীয় পুলিশদের সাহায্যে এই লজটা কার নাম আছে,সেটাও খবর নিতে বলি।প্রদীপকাকু, এবার তুমি বলো যে কি জানতে পারলে?” 

প্রদীপকাকু বললো “আমি এখানে লোকাল পুলিশের সাথে যোগাযোগ করি, জানতে পারি যে এই লজের মালিক এবং কিশোরবাবুর প্রাক্তন কর্মচারী, যিনি কিনা আগের ব্যবসার খাজাঞ্চি ছিলেন,দুজনেই সেম ব্যক্তি। এবং এই ব্যক্তির নাম হলো কৃষ্ণ চন্দ্র ব্যানার্জী, সংক্ষেপে K.C.B।”

এবার মধুবাবুকে উদ্দেশ্য করে রিকি বললো “পুরো নাম বদলালেও, নামের অর্থ একই রেখেছেন। এর থেকেই আমি  জানতে পারি যে কৃষ্ণ চন্দ্র ব্যানার্জী আর মধুসূদন বসু- দুটিই আসলে একই ব্যক্তির নাম।”

ঘরের মধ্যে সবাই হতভম্ভ।মধুবাবু মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন। মুখ রেগে লাল হয়েগেছে। এবার তিনি কথা বললেন “এসবের মধ্যে এটা কিকরে প্রমান হয় যে আমি খুনটা করেছি? আর ১০ বছর আগে যে কেউ খুনটা করতে পারে। আমি করেছি কিনা তার প্রমান কই?”

“আছে প্রমান” বললো রিকি এখানে যেদিন আসি সেদিন আপনি নিজেই আমাদের জানান একটু পুরুলিয়া যাবেন। রাস্তার যেকোনো সি.সি.টি.ভি ক্যামেরা থেকেই জানা যাবে আপনি কোথায় গেছিলেন। আর কিশোরবাবুকে মারার সময় উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন বাধা দেবার। ওনার গলায় আর নখে কিছু রোঁয়া পাওয়া গাছে। ফরেনসিক টেস্টে আপনার জামা কাপড়ের সাথে মেলালেই বোঝা যাবে আপনি সেদিন কিশোরবাবুর সাথে ছিলেন কি না। আর চিন্তামনিবাবুর খুনের প্রমান আপনাকে দেবে পুলিশ। কিশোরবাবুর জিনিসপত্র থেকেই আশা করি পাওয়া যাবে কিছু প্রমান। নাহলে উনি মরিয়া হয়ে আপনাকে ব্ল্যাক-মেল্ করতেননা । কি প্রমান আছে সেটা আশাকরি আপনিও জানেন, নাহলে আপনিও এতবড়ো পদক্ষেপ নিতেননা।”

প্রদীপকাকু উঠে দাঁড়ালো “চলো এবার ওনাকে নিয়ে যাওয়া যাক। আপনারা পুলিশের সাথে আসুন।সবাইকে যে-যার থাকার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।”

“এখনই না” বললো রিকি “আরো একটা জিনিস বাকি আছে বলো, তুমি বসো কাকু।”

“আবার কি?” প্রশ্ন করলো মোহর “এখনো সব সলভ হয়নি?”

“নাহ” বললো রিকি “একটা বিষয় এখনো বলা বাকি।বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘স্বভাব যায়না মলে’, মধুবাবুরও তাই অবস্থা। এই হোটেলটাই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করি। এক তলা থেকে অন্য তলায় যাবার দুটো স্তর সিঁড়ি আছে। প্রতি স্তরে ৮ টা করে ধাপ। খালি ৩ তলা থেকে ৪ তলায় যাবার সিঁড়ির প্রতি স্তরে ১৬ টা করে ধাপ। লিফটে করেও যেতে গিয়ে দেখলাম, ৩ থেকে ৪ তলায় উঠতে বেশিক্ষন সময় লাগছে। ব্যাপারটা আমি মধুবাবুর অনুপস্থিতিতে তদন্ত করি। তিনতলায় মধুবাবু একা থাকেন, বাকি কর্মচারীরা তেমন যায়ই না। আমার আন্দাজ ৩ থেকে ৪ তলার মাঝে আরো একটা ফ্লোর আছে, যেটা বাইরে থেকে এমন ভাবে রং করানো আছে যে বোঝা যায়না। মধুবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে আমি একটা গন্ধ পাই। গন্ধটা আমার চেনা ছিল। চিড়িয়াখানায় গেলে  সাধারণত এই গন্ধ পাওয়া যায়। হয়তো উনি এখনো প্রাণী হত্যা করেন,কিংবা চোরা-শিকারিদের দিয়ে করান।এককালে তিনিও নিজে তাই ছিলেন।কিন্তু এখানে তো বাঘ নেই, হয়তো হরিণ,হাতি এইসকল অবলা প্রাণীর হত্যা করে হরিনের চামড়া,হাতির দাঁত- এইসকল বস্তুর পাচার করেন উনি বিদেশে।এই জায়গাটা একটা ঘাঁটি হতে পারে। তিনতলায় খোঁজ নিলেই আশা করি জানা যাবে।”

এমন সময় বাইরে কোথাও বাজি ফাটার শব্দ হলো।রিকি মোহরকে বললো “১২ টা বেজে গেল।হ্যাপি নিউ ইয়ার।আশাকরি ১০ বছর আগে যে অপরাধের সূত্রপাত হয়েছিল, সেটা আজকেই শেষ হলো।”

কিছুক্ষন পর সবাই যে যার মতো ফিরতে লাগলেন। মধুবাবুকেও দুজন পুলিশ নিয়ে যেতে লাগলো।যাবার আগে উনি একবার রিকির দিকে তাকালেন আর বললেন “খুনটা করতামনা বুঝলে, চিন্তামনিবাবুর পায়ের আঘাতটা করে ছেড়ে দিতাম, ভেবেছিলাম বাঘেই এসে বাকি কাজ করেদেবে। কিন্তু ঐযে আগেই বলেছিলাম, আমার পিছনে কাছাকাছিই একটা বাঘ ডেকে ওঠে। তখন বন্দুক ওনার দিকেই তাকে করা ছিল। রিফ্লেক্সে চালিয়ে ফেলি।”

         **********************

তাহলে প্রথমবারে যে খুনটা হলো, সেটায় কিশোরবাবু নির্দোষ ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে ওর লোভ হয়ে যায়, আর ব্ল্যাক-মেল্ করতে শুরু করে মধুবাবুকে। লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু।” বললো বিপাশা।

সেদিন সারারাত লজের তিনতলা অনুসন্ধান করে পুলিশ। রিকির আন্দাজই ঠিক ছিল। অনেক বেআইনি জিনিস আর শিকার করার রাইফেল আবিষ্কার করে পুলিশ। তাদের তরফ থেকে অনেক প্রশংসা কুড়োয় রিকি। বিমানকাকুও একটা স্টোরি কভার করতে পারে। পরের দিনই ওরা গাড়ি করে ফিরতে থাকে। রাস্তায় যেতে যেতে রিকি ওর মা আর কাকিমাকে পুরো ঘটনা বলে|

“হ্যাঁ মা” বললো রিকি “ঠিক ধরেছো। আশাকরি পুলিশ এই কেসটা থেকে এরম পাচারকারী আরো দলের সন্ধান পাবে।”

বিমানকাকু বললো “হ্যাঁ। সাথে সাথে দুটো মৃত্যুর বিচারও হবে।পুলিশ মধুবাবুর সব বাড়িতেই তল্লাশি চালাবে।”

“প্রদীপকাকুতো বললো যাযা প্রমান আছে, মধুবাবুকে কাঠগড়ায় তুলতে অসুবিধা হবেনা।”

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মোহর বললো “সব তো বুঝলাম, কিন্তু আমার মতে ওনার উপর অনেক কম চার্জ করা হচ্ছে।”

রিকি বললো “একথা কেন বলছিস? সব অপরাধেরই তো সাজা পাচ্ছেন উনি।”

“কিন্তু টাকার জন্যে যেসব নিরীহ প্রাণীগুলো হত্যা হলো? একটা তো হয়নি, এতো বছরে অনেকগুলো প্রাণীহত্যা হয়েছে। এই খুন গুলোর বিচার কে করবে?”

উত্তর দিতে পারলোনা রিকি। দেবার মতো কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। মোহরের কথাটা যে নির্মম সত্য।

রিকিদের গাড়িটা বিকেলের পড়ন্ত রোদে কলকাতার দিকে যাত্রা করলো।

( সমাপ্ত )

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল