মা নিষাদ : একটি অসমাপ্ত চিত্রনাট্য

অশোক ভট্টাচার্য
5 রেটিং
1997 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

হঠাৎ আতঙ্কে চঞ্চল হয়ে উঠেছে শান্ত কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তী।

অদূরেই জেতবনে তখন বিংশতম বর্ষাবাস যাপন করছেন এক শ্রমণ।

শ্রাবস্তীর লাগোয়া জালিনী বনে তখন অভিনীত হচ্ছে এ পৃথিবীর এক বিরলতম চিত্রনাট্য। ন’শো নিরানব্বই টা কাটা আঙুলের মালা গলায় পরে এক রক্ত পিপাসু লকলকে তরবারি হাতে উন্মাদের মতো খুঁজে চলেছে আরো একটি আঙুল। এক সহস্র দক্ষিণ হস্তের কাটা আঙুলের মালা তাকে গলায় পরতেই হবে,তবেই গুরু-শাপমোচন হবে তার।

এত রক্ত কেন??

“আঙুল চাই- আঙুল চাই…” তাই নরহত্যা আবশ্যিক। গুরুকে কথা দিয়েছে এই ব্যক্তি এক সহস্র মানুষের ডান হাতের কাটা বুড়ো আঙুল সে গুরু চরণে এনে নিবেদন করবে।

অথচ শান্ত নীপবিথী বেষ্টিত সারস্বত আরাধনার তপোভূম, জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে একদিন এই গুরুই তাঁর এই শিষ্যকে শিখিয়েছিলেন—

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।”

আজ কী দুজনেই বিস্মৃত জগতের সেই আদিতম চির শাশ্বত শ্লোকের নির্যাস? তক্ষশিলার মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর কী তবে আজ অন্য কোনো আগ্রাসী করের থাবা?

জেতবনে বসে বিচলিত হয়ে উঠলেন শ্রমণ। একী দেখতে পাচ্ছেন তিনি তাঁর দিব্য দৃষ্টি দিয়ে!

‘অহিংসক…অহিংসক ‘ বলে কাতর ও আকুল কণ্ঠে ডাকতে ডাকতে এক মা তাঁর সন্তানের খোঁজে জালিনী বনে প্রবেশ করলেন।

‘ কে অহিংসক? আমি কোনো অহিংসককে চিনি না..’– বলে উঠলো সেই রক্তপিপাসু উন্মাদ।

“তুই আমাদের অহিংসক বাবা”–মা বললেন আবার কাতর স্বরে।
” চ বাবা। ঘরে চল..”

উন্মাদ বলে উঠলো,” আমি অঙ্গুরীমাল। আরো একটি দক্ষিণহস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি আমার চাই..তুমি যেই হও, তোমাকেই হত্যা করে এক সহস্র কাটা আঙুলের মালা আমি নিবেদন করব গুরু চরণে”।

চোখের সামনে মাতৃহত্যার দৃশ্য! শ্রমণ দেখবেন কী করে!

মা ও ছেলের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন শ্রমণ।

উন্মাদ অঙ্গুরীমাল এবার শ্রমণ কে হত্যা করতে উদ্যত হলো। আরো একটি আঙুল চাই ই চাই তার।

কিন্তু একী! শ্রমণকে স্পর্শ করতে পারছে না সে। শ্রমণের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে সে ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছে। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনি কে শ্রমণ?”

” আমি গৌতম বুদ্ধ”, স্মিতহাস্যে বললেন সেই শ্রমণ।

অঙ্গুরীমাল ধীরে ধীরে নতজানু হয়ে বুদ্ধের পদতলে নিজেকে সমর্পণ করলেন। তার মনে পড়ে যাচ্ছে সব। সে তো ব্রাহ্মণ ভার্গবের সন্তান ‘অহিংসক’। এ হিংসা তো তার জন্য নয়।

রাজা প্রসেনজিৎ ততক্ষণে সসৈন্যে পৌঁছে গ্যাছেন জালিনী বনে; অঙ্গুরীমালকে যেভাবে হোক আটক করতে হবে।

কিন্তু এ কী! এ কে? ভগবান বুদ্ধের পাশে এক নিরহংকারী দৃষ্টি, এক অপাপবিদ্ধ মুখ নিয়ে আরো এক শ্রমণ। “এ তো সেই আমাদের অহিংসক!”

কিন্তু বুদ্ধদেব আবার বিচলিত নেত্রে তাকিয়ে কেন?

অনেক দূরের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন তিনি?

আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে এক রক্তনদীর ধারা।

আ..আহ্.. আবার হত্যা!

এক অর্ধ উলঙ্গ ভিখারি প্রার্থনা সভায় সবে প্রার্থনা সমাপ্ত করেছেন৷ একে একে নত মস্তকে সকলে তাঁর চরণ ছুঁতে ব্যস্ত..হঠাৎ ক্ষিতি- অপ- মরুৎ- ব্যোম বিদীর্ণকারী আওয়াজ!

রক্তস্রোতে পা ভিজিয়ে একুশ শতকের মাটিতে পদচিহ্ন আঁকছে অঙ্গুরীমালেরা।

‘হে রাম.. হে রাম..হে রাম..” বলে প্রতি পলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন সেই আটহাতি বস্ত্র পরিহিত চির ভিখারি মানুষটি।

সেই অঙ্গুরীমাল! একুশ শতকের সেই অঙ্গুরীমালদের কে আবার পুনর্জীবন দান করে ‘অহিংসক’ করে তুলবে? সে কাজ যাঁর করার ছিলো তিনিই তো রোজ লুটিয়ে পড়ছেন মাটিতে। রোজ একবার করে হত্যা করা হচ্ছে তাঁকে।

ক্যামেরা প্যান করছে…

ততক্ষণে আরো এক তপোবন, শান্তিনিকেতনে শোনা যাচ্ছে আরো এক বিদেহী ঋষি কণ্ঠে…

“তোর চেয়ে আমি সত্য, এ বিশ্বাসে প্রাণ দিব দেখ।
শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক…”

©অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা)

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল