লাইফ লাইন অফ সিকিম

শ্রীপর্না পাল
5 রেটিং
1292 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

ইচ্ছে করছে সবার সাথে ভাগ করতে আমার প্রথম পাহাড় দেখার অনুভূতি।। সে যে কি অনুভূতি তা বলে বোঝানো কতটা সম্ভব জানি না।। তাও চেষ্টা করছি।।
সকাল তখন ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট দার্জিলিং মেল পৌছায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।। স্টেশনে ঢোকার সময় আমার নজর কেড়েছিলো দূরের পাহাড়ের হালকা রেখা।। সেই দেখে মনকে স্থির রাখাটা বড়ই কঠিন।।

আচ্ছা বলুন তো মানুষ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কতটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে।। আর যদি স্বপ্নটা হয় গুরুদংমার লেক।। হ‍্যাঁ প্রথমবার নামটা শোনা মাত্র আমিও আঁতকে উঠেছিলাম।। আর যখন শুনলাম গুরুদংমার লেক যাওয়ার রাস্তায় সাক্ষাৎ  হতে পারে রঙ-বেরঙের বিপদের সাথে।। তাছাড়া ঘুরতে এসে ভয়ে গুঁটিয়ে না থেকে অদেখা জিনিসকে যতটা সম্ভব প্রানভরে উপভোগ করতে পারা যায় ততই শ্রেয়।।

রাত তখন প্রায় ২ টো বেজে ১০ মিনিট, দরজায় করাঘাতে ঘুম ভাঙ্গলো।। প্রচন্ড ঠান্ডায় কম্বল আঁকড়ে খাটের ওপর বসেছিলাম খানিকক্ষণ।। কম্বল ছেড়ে মেঝেতে লাফ দিতেই টের পেলাম ঠান্ডায় হাত পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।। চটপট ready হয়ে বেরোলাম যখন স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তখন বাজে রাত ২:৫০।। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কনকনে ঠান্ডায়, সংকীর্ণ রাস্তা ধরে ছুটলো আমাদের দুটো বুলেরো।। একপাশে খাঁড়া পাহাড় আর অন্য পাশে খাঁদ।। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে দেখা মেলে ঝিমন্ত চামরী গাইয়ের দল।। পিচ রাস্তা কখন যে উধাও হয়ে গেছে তার টেরটিও পায়নি।। খানিক রাস্তা এগোতে না এগোতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছিল ঘুমে।। টানা দুই ঘণ্টা সফরের পর পৌঁছালাম ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ছাউনীর কাছে, যেখান থেকে অনুমতি নিয়ে দৌড়ালাম স্বপ্নকে ছুঁতে।। অনুমতি না পেলে ফিরে যেতে হত লাচেনে।। পারতাম না আজ হয়তো এতদিনের সঞ্চিত স্বপ্নকে চোখের সামনে সত‍্যি হতে দেখতে।। আর এরপর থেকেই শুরু হল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিকে যতটা সম্ভব মনের এককোনে বন্দী করে রাখার প্রচেষ্টা।

আকাশে বর্নিত ক্ষীণ আলোর ছটা চোখে পরতেই বাইরে উঁকি দেওয়ায় মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল।। ‘এ কোন পৃথিবীতে এসে পরেছি’, জনমানবশূন্য, গাছপালা হীন এক অন‍্য পৃথিবী।।

গুরুদংমার লেক পৌঁছানোর কিছু সময় পূর্বে আমার ঠিক এরকমই মতিভ্রম ঘটেছিলো।। আসলে অপেক্ষার প্রহর গোনার পালা শেষ হয়ে যখন পরলাম এক প্রকান্ড তিব্বতীয় মালভূমির আঙিনায়, সেই মুহূর্তে এক অপার সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে ছিলাম।। এমন সৌন্দর্য যা গায়ের রোম খাড়া করে দেয়, এমন সৌন্দর্য যা ভাষায় প্রকাশ করা কারোরই পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়।। যে সৌন্দর্য এখনও আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।।

‘জাদাতর দশমিনিট আপলোগ রহে সক্তেহো ইধার সাব’ বলল আমাদের ড্রাইভার।। অক্সিজেনের অভাবের জন্য বেশিক্ষণ সময় থাকতে পারা যায় না।। ১৭১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কল্পনার মায়াজাল দিয়ে বোনা এই গুরুদংমার লেক।। আর যখন প্রথম সূর্যের আলোয় মেঘের চাদর সরে গিয়ে পাহাড়ের ছায়া গুরুদংমারের জলে প্রতিফলিত হয়ে এক নৈসর্গিক দৃশ্য তুলে ধরে চোখের সামনে।।
(তাপমাত্রা ছিল সম্ভবত – ৫°)

এখানে বেলা গড়ানোর সাথে সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে পাথর ওড়ে।। তাই আর বেশিক্ষণ থাকতে সাহস হচ্ছিল না।। চামরী গাইয়ের দুধের চা (আজব স্বাদ্) আর ম‍্যাগী ছিল আজকের প্রাতঃরাশ ছাঙ্গীতে।।

রোদের রোয়াব আস্তে আস্তে বাড়লেও এলোপাতাড়ি দমকা হাওয়ার ছোবলে শরীরের সংবেদনশক্তি ম্লান হয়ে গেছিলো।।

চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাহাড়ের গায়ে হাত দিয়ে কেউ যেন সযত্নে বরফ লেপে দিয়েছে।। এমন‌ এক জায়গা যেখানে হাজার খুঁজলেও সবুজের দেখা তো দূরের কথা, সংকেত পাওয়া যাবে নাকি সন্দেহ।। হ‍্যাঁ, এটাই হলো জিরো পয়েন্ট (তাপমাত্রার হিসেবে)।।

প্রথম বরফের স্পর্শ মনকে ভিজিয়ে দিয়েছিল।। বরফের সাথে যুগলবন্দী করে অপরকে আঘাত করেছিলাম (বরফ ছুঁড়ে) আর প্রত‍্যেকবার খিলখিলিয়ে হেসে বরফের কোলে লুটিয়ে পড়েছিলাম।। শরীরের বিষক্রিয়া (হাওয়ার ছোবলে) নিবারণের চেষ্টায় শীঘ্রই বিদায় সংবর্ধনা জানিয়ে পা বাড়ালাম ইয়ুমথাংয়ের পথে।।

ইয়ুমথাং ভ‍্যালির বুক চিরে বয়ে যাওয়া লাচুং চু (‘চু’ শব্দের অর্থ নদী), যার রুপ দেখলে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে।। দুর্বল হয়ে পড়ে মন আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাড়া করে বেড়ায় একরাশ ঠান্ডা হাওয়া।।

কাঞ্চনের নেশায় আমি দিক-বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে  পড়েছিলাম।। প্রশ্ন করেছিলাম নিজেকে_’একি নিছক কোনো নেশা, নাকি ভালোবাসা’।।

কাঞ্চনের আলগা চিহ্ন পেতে হানা দিলাম পাহাড়ের কোলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা একটি ছোট্ট শহর, নাম তার পেলিং।।

ছুটে ছুটে এখানে আসার একটাই কারণ আবেগ মাখানো কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোরের আড়মোড়া ভাঙা দেখবো বলে।।

গাঢ়ো ঘুম  ভাঙিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ৪:৩০ থেকে উঠে বসে ছিলাম করিডোরে, সাথে পরিবারের সদস্যরা।। মনে মনে বললাম_’তেনার ঘুম থেকে ওঠার কোনো নামই নেই’
ঘড়ির কাঁটা যখন ৫ টা বেজে ১০ ছুঁই ছুঁই তখনই পূব আকাশ থেকে মৃদু হেসে উঠলো সূর্য, আর সাথে সাথে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙালো কাঞ্চন।। সূর্যের বহুরুপী হাসির ভঙ্গিতে চোখের সামনে এক এক রুপে রচিত হয়েছিল কাঞ্চন, আমার কাঞ্চন।।

এই ছিল আমার প্রথম পাহাড় দেখার অনুভূতি, আপনাদের অনুভূতির টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলুন স্মৃতির ভেলা।।

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Niloy October 30, 2018 at 10:52 am

    সিকিমের স্মৃতি ফিরে এলো।

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল