কলকাতায় তখন ফুটবলের জয়জয়কার। মোহনবাগান ইস্টইয়র্ক নামক সাহেবদের দলকে খালি পায়ে হারিয়ে জাতীয়তাবাদের হিল্লোল তুলেছে ভারতবাসীর বুকে। সেই মোহনবাগান দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন শিবদাস ভাদুড়ী। যিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। এক পূর্ববঙ্গীয়ের হাত ধরে লেখা হলো ইতিহাস। কিন্তু মোহনবাগান ছিলো হাওড়া কলকাতার বাবুদের ক্লাব। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষরা, যাদের ভাষা সংস্কৃতি ছিলো আলাদা, তাদেরকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না মোহনবাগান কর্তারা। বাঙালদের কিছু না থাক গোঁ আছে খুব। তারা সংগঠিত হলো, গড়তে চাইলো এক নতুন ক্লাব। এর মধ্যে কোচবিহার কাপের ফাইনালে খেলা মোহনবাগান আর জোড়াবাগানের মধ্যে। জোড়াবাগান হারলে তাদের প্রেসিডেন্ট হারের দায় চাপান দুই বাঙাল খেলোয়াড়ের ওপর। এতে অপমানিত হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট সুরেশ চৌধুরী ওই ক্লাব ছেড়ে বাঙালদের নিয়ে গড়লেন এক ফুটবল ক্লাব। নাম দিলেন ইস্টবেঙ্গল। ১৯২০ সালের ১লা আগস্ট, জন্ম নিলো এক আবেগ, এক লড়াই, এক আগুন, এক হার না মানা জেদ, নাম তার ইস্টবেঙ্গল। আবেগের সেই মশালটা আজ ১০০ বছর পরেও একই রকম উজ্জ্বল। কতো স্মৃতি, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বেঁচে থাকার উপাদান ওই লাল হলুদের সঙ্গে।
এতোটা আবেগ হয়তো থাকতো না, যদি না দেশভাগের শিকার হয়ে সর্বহারা ছিন্নমূল মানুষের দল এদেশে আসতেন।উদ্বাস্তু মানুষের দল তখন এদেশে বাঙাল, কাঁটাতার, অবাঞ্ছিত। পদে পদে অবহেলা, পায়ের তলায় মাটি পাবার লড়াই। আর সমস্ত বঞ্চনা উপেক্ষার জবাব দেবার একটাই হাতিয়ার, ইস্টবেঙ্গল।
আজ শতবর্ষের আলোয় উদ্ভাসিত ইস্টবেঙ্গলের কিছু গৌরব জনক অধ্যায় ফিরে দেখি, যেগুলি শুধু ট্রফি বা জয় না, সেগুলি এক লড়াই, এক স্বপ্নপূরণের স্বীকৃতি, এক বেচেঁ থাকার রসদ।
#স্মরণীয়জয়
ইস্টবেঙ্গল জাতীয় লিগ জিতেছে ৩ বার,ফেডারেশন কাপ ৭ বার, সুপার কাপ ৩ বার, আইএফএ শিল্ড ২৩, ডুরান্ড কাপ ১৫ বার।সর্বভারতীয় এই সব প্রতিযোগিতার সাথে আছে বহুবার কলকাতা লিগ জয়। ভারতের মাটিতে বার বার উড়েছে লাল হলুদ পতাকা, জ্বলেছে মশাল, আবেগে ভেসেছে বাংলা ওই লাল হলুদের সাথে।তবে এইসব জয়ের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে কিছু শক্তিশালি বিদেশি দলের বিরুদ্ধে জয়। ১৯৭০ এর আইএফএ শিল্ডের ফাইনাল। সামনে ইরানের শক্তিশালী দল পাস ক্লাব। গতি দম শক্তি স্কিল সবেতেই ভারতীয় দল গুলির চেয়ে অনেক এগিয়ে দলটি। ফাইনালের রেজাল্ট সবারই জানা।তবু প্রিয় দলের লড়াই দেখতে গ্যালারি কানায় কানায় ভরিয়ে দিলো সমর্থকরা। আকাশ ফাটানো গর্জনের মধ্যে মাঠে নামলো লাল হলুদ ব্রিগেড। উজাড় করে দিলো তারা। অদম্য লড়াইয়ের কাছে হার মানলো ইরানের বিখ্যাত ক্লাবটি। পরিমল দের শেষ মুহূর্তের গোলে জয় ছিনিয়ে নিলো লাল হলুদ। ক্লাব বা রাজ্য নয়, দেশকে গর্বিত করলো ইস্টবেঙ্গল।
১৯৭৩ সালে তাদের দাপটে পরপর পরাস্ত হলো দুই কোরিয়ান দল। শিল্ডের ফাইনালে হারালো উত্তর কোরিয়ার বিখ্যাত দল পিয়ং ইয়ং সিটিকে। আর ডিসিএম ট্রফিতে পরাজিত হলো দক্ষিণ কোরিয়ার ডক রো গ্যাং।ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে এইসব জয়।
এরপর ২০০৩, আশিয়ান কাপ খেলতে গেলো ইস্টবেঙ্গল। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার দলের সাথে সমগ্র টুর্নামেন্টে দারুন খেললো লালহলুদ।ফাইনালে তাদের মুখোমুখি থাইল্যান্ডের বিখ্যাত দল বেক তেরো সাসানা। সেই দলের প্রধান স্তম্ভ আগের বছরের এশিয়ার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হওয়া চাইম্যান। কোচ সুভাষ ভৌমিক লাল হলুদ ফুটবলারদের বললেন, কাপ চাইনা, ভারতেও যে ফুটবল খেলা হয়, তোমরাও যে ফুটবলটা খেলতে জানো বিশ্বকে আজ সেটা জানিয়ে দেবার দিন।খেলেছিল সেদিন ইস্টবেঙ্গল। হুগলীর অখ্যাত গ্রামের ষষ্ঠী দুলে বোতল বন্দী করে রেখেছিল চাইম্যানকে। ভারতকে গর্বিত করে আশিয়ান কাপ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। বিমানবন্দর লাল হলুদ পতাকার সাথে ছেয়ে গিয়েছিল জাতীয় পতাকায়।
#নৌকাডুবিরকথা
যে দলটা সৃষ্টিই হয়েছিল, কলকাতার বাবুদের করা অপমানের জবাব দেবার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে, কাপ শিল্ড নয়, সেই দলের প্রধান লক্ষ্যই যে মোহনবাগানকে হারানো একথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২৫ সালে। মোহনবাগান ভাবছে বাঙালদের আজ উড়িয়ে দেবো।আর ইস্টবেঙ্গল ভাবছে আজ সব অপমান, তাচ্ছিল্যের জবাব দেবার দিন।তুমুল উত্তেজনায় শুরু হলো খেলা।সবুজমেরুনের সঙ্গে লাল হলুদের প্রথম দ্বৈরথ। তুল্য মূল্য লড়াইতে শেষ পর্যন্ত নেপাল চক্রবর্তীর করা একমাত্র গোলে জেতে ইস্টবেঙ্গল। তারপর থেকে বহুবার বহু ম্যাচে মোহনবাগানের পালতোলা নৌকা ডুবেছে লাল হলুদ ঝড়ে। পরিসংখ্যান বলছে দুই দলের সাক্ষাতে ইলিশ জিতেছে ১২৭ বার, চিংড়ি ১১৬ বার। এখানে এগিয়ে লাল হলুদ ই।
১৯৭৫ এর ঐতিহাসিক জয়,,,, সেবার শিল্ড ফাইনাল। ৭ এর দশক মানেই ইস্টবেঙ্গলের দশক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার স্রোতের মত শরণার্থীরা আসতে থাকে পশ্চিমবাংলায়। সবহারা মানুষগুলির কাছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এর প্রতীক ছিলো ইস্টবেঙ্গল। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। সুব্রত, প্রসূন, ভাস্কর গাঙ্গুলি বড়ো বড়ো নাম সব মোহনবাগানের দলে। আর ইস্টবেঙ্গল, প্লেয়ার নয়, নামটাই যথেষ্ট। খেলা শুরু হলো। যেন মশাল হাতে নিয়ে নেমেছিল ইস্টবেঙ্গল। পাল তোলা নৌকার পালে দাউ দাউ দাউ করে আগুন লাগিয়ে দিলো। প্রথম অর্ধেই ৩-০, পরের হাফে আরো ২। পাঁচ গোলের মালা পরে নৌকা তখন অথৈ জলে। সুব্রত ভট্টাচার্যরা পাবলিকের আক্রমন থেকে বাঁচতে রাত কাটিয়েছিলেন নৌকায়।পাঁচ আঙুলের সেই দাগ আজও রয়ে গেছে মোহনবাগানের অহংকারের মাঝে ক্ষত চিহ্ন হয়ে। ২০০৯ এ একবার ৫-৩ হয়েছিল।কিন্তু ৫-০, আর ৫-৩ কি আর এক হলোরে পাগলা!
ডায়মন্ড ম্যাচ,,, ১৯৯৭ এর ১৩ ই জুলাই। কলকাতা জুড়ে হঠাৎ ফুটবলের সুনামি। মোহনবাগান টিম সেবার তারকা খচিত। চিমা, বিজয়ন, দিপেন্দু,খালেক ভয় জাগানো ফরোয়ার্ড লাইন। আর ইস্টবেঙ্গলে ওমোলো আর বাইচুং ভুটিয়া। মোহনবাগানের কোচ অমল দত্ত, ইস্টবেঙ্গল নিলো চির প্রতিদ্বন্দ্বী পিকে ব্যানার্জীকে। অমল দত্ত দলকে খেলাচ্ছেন ডায়মন্ড সিস্টেমে। প্রতিপক্ষকে গোলের মালা পরিয়ে ফেড কাপের সেমিফাইনালে সবুজ মেরুন। অন্য দিক থেকে উঠলো লাল হলুদ। উত্তেজনা তুঙ্গে, মাঠে টিকিটের হাহাকার। উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিলেন অমল দত্ত। ওমলেট, চুংচুং, শসা বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করলেন ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের। ১ লাখ ৩১ হাজার দর্শকের সামনে শুরু হলো ম্যাচ। মোহন বাগান ঢেউএর মত আক্রমন শানাচ্ছে। কোনোমতে রুখছে ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্স। ম্যাচের গতির বিরুদ্ধে সেট পিস থেকে হঠাৎ গোল পেলো ইস্টবেঙ্গল। তারপর, খেলা ধরলো তারা। পাহাড়ি ঝর্নার ধারায় ভেসে গেলো সবুজ মেরুন ডিফেন্স। পরপর তিন গোল করে বড় ম্যাচে প্রথম হ্যাট্রিক করলেন বাইচুং। ডায়মন্ড কাচের মতো চূর্ণ হলো ৪-১ গোলে। ঐতিহাসিক ম্যাচে ছারখার হয়ে গেল বাগান। এর নাম ইস্টবেঙ্গল।আগুন তাদের রক্তে।
অবশেষে এলো সেই কলঙ্ক মাখা দিন। আই লিগে ২০১২ সালের ডার্বি। প্রচুর দর্শকের সামনে খেলতে নামলো দুই দল। ইস্টবেঙ্গল শুরু করলো প্রচন্ড গতিতে। সেই গতির সাথে কিছুতেই পাল্লা দিতে পারছে না বাগান প্লেয়াররা।শুরু করলো রাফ ফুটবল। বল ছেড়ে পা চালাতে লাগলো বিপক্ষকে লক্ষ্য করে। ইস্টবেঙ্গল সেদিন অপ্রতিরোধ্য। প্রথম ১৫ মিনিটে ৪ টি কার্ড দেখলো বাগান। মার তবুও থামলো না। গোল করলো ইস্টবেঙ্গল। বাগান সমর্থকেরা ক্ষেপে উঠলো। এরপর ওডাফা লাল কার্ড দেখতেই মাঠে শুরু হলো ইট বৃষ্টি। নিজেদেরই প্লেয়ার রহিম নবি মারাত্মক আহত হলেন। ইস্টবেঙ্গল প্লেয়াররা ছুটে এসে উদ্ধার করলো রক্তাক্ত নবিকে। তারপর পাল গুটিয়ে মাঠ ছাড়লো মোহনবাগান। যাদের দেশত্যাগী বলে ব্যঙ্গ করতো তাদের ভয়ে মাঠ ছেড়ে পালালো জাতীয় দল। ইস্টবেঙ্গল বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলো। কিন্তু আর নামেনি সবুজ মেরুন নৌকা। ৩-০ ম্যাচ জিতেছিল লাল হলুদ। আজও মাঠ ছেড়ে পালানোর লজ্জা তাড়া করে মোহনবাগান কে।
#জ্বলুকমশাল
আজ লাল হলুদের শতবর্ষ। অনুষ্ঠানে,উৎসবে, আড়ম্বরে ভাসবে ময়দান। কিন্তু ফুটবলে আজ ভাটার টান।বাঙালি প্লেয়ারের বড়োই অভাব। সেই প্রাণের যোগটাই হারিয়ে যাচ্ছে আজ। বাংলা আবার এগিয়ে আসুক ফুটবলে। নতুন নতুন খেলোয়াড় মাঠ মাতিয়ে দিক। জ্বলুক গর্বের মশাল। হৃদয়ে থাকুক ইস্টবেঙ্গল।
তথ্য সূত্র ,,,গুগল, উইকিপিডিয়া