জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনী ‘তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরি’তে ব্যক্ত করেছেন রত্নের প্রতি তাঁর তীব্র আসক্তির কথা। আর তিনি যে এই আসক্তি তাঁর তৃতীয় পুত্র রাজকুমার খুররমের জিনে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন, সে কথাও লিখে গেছেন। খুররম যে রত্নশাস্ত্রের প্রগাঢ় জ্ঞানে তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছেন, তা নিয়ে তিনি বিশেষ গর্ব প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে; তিনি খুররমকে ‘বাসনা, আকাঙ্খা ও সমৃদ্ধির ললাটে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক’ মনে করতেন। খুররমের রত্ন চেনার জহুরির চোখের একটা সুন্দর গল্প বলেছেন তিনি। একবার জাহাঙ্গীরকে কোনো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একটি অনিন্দ্যসুন্দর বড় মুক্তো উপহার করেন। মুক্তোটির রং, গড়ন, আকার সব কিছুই যেন একেবারেই আলাদা। সম্রাটের খুব ইচ্ছে যদি এই একই ধরণের আর একটি মুক্তো পাওয়া যায় তবে তিনি একটি বাজুবন্ধনী বানিয়ে নেবেন। খুররমকে বলতেই তিনি সেই মুক্তোটি খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করে বললেন যে বহুবছর আগে রাজকোষে তিনি একটি ঠিক একই ধরণের মুক্তো দেখেছিলেন একটি সরপেচ-এ (পাগড়ির অলংকার)। অনেক খুঁজে যখন সেই মুক্তোটি রাজকোষে পাওয়া গেলো, তখন দেখা গেলো, দুটি মুক্তোর রং, ঔজ্জ্বল্য, গড়ন, ওজন, আকার সব কিছু একেবারে এক। দেখে মনে হবে যেন মুক্তো দুটির সৃষ্টি একই ঝিনুকের পেটে। সম্রাট ওই দুটি মুক্তো আর একটি চুনি দিয়ে একটি সুন্দর বাজুবন্ধনী গড়িয়ে নেন। এই খুররম কালক্রমে হলেন জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকারী, পরবর্তী মুঘল বাদশাহ শাহ জাহান।
মুঘল বংশের ঐশ্বর্য-প্রীতির ‘পোস্টার বয়’ শাহ জাহান।এডওয়ার্ড টেরি, ব্রিটিশ দূত স্যর টমাস রো’র যাজক। শাহ জাহানকে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট রত্নসংগ্রাহক ও রত্ন সংক্রান্ত ব্যাপারে সবচাইতে সমঝদার মানুষ হিসাবে বর্ণিত করেছেন।কালক্রমে শাহ জাহানের সুন্দর ও মূল্যবান রত্নের প্রতি আসক্তি ও এ সংক্রান্ত জ্ঞান জাহাঙ্গীরের থেকেও বহুগুন বেড়ে গিয়েছিলো।১৬২৮ সালে ফ্রায়ার ম্যানরিক নামে এক পর্তুগিজ যাজক এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তিনি ধর্মপ্রচারের কাজে ঢাকায় বহুদিন ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আরাকানে চলে যান। ১৬৪২ সালে তিনি তাঁর দেশে ফেরত যান।সম্রাট শাহ জাহানের রত্নের প্রতি অখণ্ড মনোযোগের একটি গল্প শুনিয়েছিলেন ম্যানরিক। একবার সম্রাটের দরবারে তাঁর শ্যালক আসফ খান নিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু বহুমূল্য রত্ন। সম্রাট যখন রত্ন দেখতে ব্যস্ত, তখন দরবারে চলছে স্বল্পবাস লাস্যময়ী নর্তকীদের ইঙ্গিতময় ও কামাতুর নাচ। সেই নর্তকীর দলও তাঁর মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেননি। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি রত্ন থেকে দৃষ্টি সড়াননি, বরং পুরো সময়টা ব্যস্ত ছিলেন রত্নগুলির মূল্য নির্ধারণে। অস্ট্রিয়ান স্থাপত্য-ঐতিহাসিক এবা কচ মুঘল সাম্রাজ্যের শিল্প ও স্থাপত্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। ‘দ্য মুঘলস এন্ড দেয়ার লাভ ফর প্রেশাস স্টোনস’ নামে তাঁর একটি বইতে লিখেছেন শাহ জাহানের রত্নপ্রীতির এক অতুলনীয় উদাহরণ।
মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পর তাঁর বিয়োগ ব্যাথায় শাহ জাহান অনবরত চোখের জল ফেলতেন। এতে তাঁর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়। তিনি তখন এক জোড়া রত্নখচিত চশমা ব্যবহার করা শুরু করেন। একটির লেন্স ছিল হিরের আর অপরটির লেন্স ছিল পান্নার তৈরী। রত্নের এমন ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা বিশেষ শোনা যায়না।
এ সব কিছু কি শুধুই বাদশাহী বিলাসিতা? শাহ জাহানের শিল্প সংক্রান্ত চিন্তাধারা, রত্ন বিলাসিতার মধ্যে ছিল সযত্নে লালিত বংশানুক্রমিক মুঘল সাম্রাজ্যবাদের প্রচারণা। তিনি নিজেকে শুধুমাত্র শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, তাঁর শিল্প-সৌষ্ঠবের দীপ্তির মাধ্যমে তিনি এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে তিনি স্বয়ং ঈশ্বর প্রেরিত আলোকবর্তিকা। সম্প্রতি লন্ডনের আর্ট-মার্কেটে শাহ জাহানের ব্যবহৃত একটি রত্নখচিত খঞ্জর আবর্তিত হয়। সেই খঞ্জরের খাপে ছিল খোদাই করা কিছু শব্দ, যা মুঘলদের সাম্রাজ্যবাদী আকঙ্খার প্রচার হিসেবে ধরাই যেতে পারে। ‘এই খঞ্জরের অধিকারী যিনি, তিনি হলেন রাজার রাজা, এই সমগ্র বিশ্বের অধীশ্বর আর ধর্মরক্ষক। স্বর্গ-মর্ত্য শুভ-সংযোগের দ্বিতীয় বিধাতা সম্রাট শাহ জাহান সূর্যের মতো দ্যুতিময় প্রকাশে সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করে থাকেন’।
শাহ জাহানের রত্নকোষে বড় আকারের হিরের আমদানি ঘটে সেই সময়ের আর এক নামকরা রত্ন বিশারদ ও রত্ন সংগ্রাহক মীর জুমলার সাহায্যে। জন্মসূত্রে পার্সি মীর জুমলা ছিলেন এক বণিক ও রত্নব্যবসায়ী। ভেনিসের পরিব্রাজক নিকোলাও মানুচি তাঁকে দেখেছিলেন রাস্তায় ও বিভিন্ন বাড়ির দরজায় জুতো ফিরি করতে। কিছুটা নিজের পরিশ্রমের জোরে আর কিছুটা ভাগ্যের জোরে হয়ে উঠলেন এক বিখ্যাত অর্থবান বণিক, সাগর থেকে সাগরে ছিল তাঁর বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজ। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন শহরে ছিল তাঁর দপ্তর। কালক্রমে তিনি হয়ে উঠলেন গোলকুণ্ডার প্রধান মন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রিত্বের সময় কর্ণাটক প্রদেশের বিভিন্ন খনি ও হিন্দু মন্দির থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ রত্ন সংগ্রহ (বা বলা ভালো লুট) করেন। তাঁর সংগ্রহ থেকে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশিষ্টজনকে নিয়মিত রত্ন বিক্রি করতেন ও উপহার দিতেন।
মীর জুমলার কথা যখন এলো, তখন তাঁকে নিয়ে একটি চমৎকার (বরং ভয়ঙ্কর) গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না, যদিও কোহিনূরের নিরিখে সেই গল্প নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। মীর জুমলার এক ঘনিষ্ঠ ফরাসি বণিক ছিলেন, তিনিও মীর জুমলার মতো রত্নব্যবসায়ী ছিলেন, নাম ছিল জ্যঁ বাপ্তিস্ত তেভারনিয়ে। একবার তেভারনিয়ে গিয়েছিলেন মীর জুমলার সাথে দেখা করতে, গোলকুণ্ডার এক গ্রামে, সেখানে এক সন্ধ্যায় একটি শিবিরে তিনি ব্যস্ত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি ও ব্যবসায়িক চিঠির উত্তর দিতে। তাঁর বাঁ হাতে চিঠির তাড়া, ডান পায়ের বিভিন্ন আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন চিঠি গোঁজা। তিনি বসে আছেন কেদারায়, ডান পা’টি ভাঁজ করে বাঁ উরুর ওপর তোলা, সামনে তাঁর সেক্রেটারি। তিনি নিজে লিখছেন সাথে সেক্রেটারিকেও নির্দেশ দিচ্ছেন অন্য কোনো চিঠির ব্যাপারে। ইতিমধ্যে রক্ষী এলো চার অপরাধীকে নিয়ে। সেই চিঠি লেখার মধ্যেই মাথা না তুলেই তিনি রক্ষীকে নির্দেশ দিলেন ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। চিঠি লেখার ফাঁকে ফাঁকে মুখ না তুলেই তিনি অপরাধীদের প্রশ্ন করে যেতে থাকলেন। ইতিমধ্যে খানসামা এসে পৌঁছলো তাঁর রাতের খাবার নিয়ে।অপরাধীরা অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে, মীর জুমলা কিন্তু শান্ত ভাবে তাঁর হাতের কাজ শেষ করতে থাকলেন। খানসামা ও দাঁড়িয়ে আছে খাবার নিয়ে। এক ঘন্টা পরে তাঁর চিঠি লেখার পাট শেষ হলে মাথা তুলে রক্ষীকে আদেশ দিলেন দুই অপরাধীর মুণ্ডচ্ছেদ করতে, এক অপরাধীর পেট চিরে নর্দমায় ফেলে দিতে আর বাকি অপরাধীর হাত ও পা কেটে নিয়ে মাঠে ফেলে রেখে ধীরে ধীরে মেরে ফেলতে। আদেশ শেষে তিনি তাঁর ফরাসি বণিক বন্ধুর সাথে রাতের খাবার খেতে শুরু করলেন।
এহেন মীর জুমলা যখন ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে, তখন তিনি গোলকুণ্ডার সুলতানের বিরাগভাজন হলেন। সুলতানের অভিযোগ, তিনি নাকি রাজ্যের রানীর সঙ্গে প্রণয়-ঘটিত সম্পর্কে লিপ্ত। ১৬৫০-র দশকে শাহ জাহান তখন দাক্ষিণাত্যে সীমানা বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছেন। ‘শাহ জাহান নামা’ গ্রন্থে কারণ হিসেবে বলা আছে, দাক্ষিণাত্যে বিভিন্ন হিরের খনির উপস্থিতি। মীর জুমলা তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন, গোলকুণ্ডার সুলতানের থেকে শাহ জাহানের অনুগত হওয়া ছিল বেশি লাভজনক। মানুচির বর্ণনা অনুযায়ী, ১৬৫৬-র বর্ষায় লালকেল্লায় দ্বার উদ্ঘাটনের দিন তিনি শাহ জাহানের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন ও তার স্মারক হিসেবে একটি ৩৬০ ক্যারেটের একটি বড় অবিকৃত হিরে উপহার দেন। শাহ জাহান নামায় ওই হিরের ওজন বলা আছে ২১৬ রতি (১ রতি = ০.৯১ ক্যারেট)। অন্যদিকে তেভারনিয়ে লিখেছেন এই হীরেটির ওজন ৯০০ রতি বা ৭৮৭ ক্যারেট। তিনি এও বলেছিলেন যে এই হিরেটি কর্ণাটকের কোল্লুরের খনি থেকে প্রাপ্ত।
তিনটি তথ্যসূত্রে তিন ধরণের ওজনের কথা বলা হয়েছে, প্রতি সূত্রই হীরেটির অস্বাভাবিক ওজনের কথাই নির্দেশ করেছে। রত্নব্যবসায়ী তেভারনিয়ের কথা অনুযায়ী তাই মনে করা হয়, কোল্লুরের খনি থেকে প্রাপ্ত এই হিরে হলো মুঘলদের রাজকোষাগারে সম্পূর্ণ নতুন ও অনুপম অতিথি, যা মুঘলরা আগে কখনো চোখে দেখেননি।বহু বছর বাদে ইংল্যান্ডের ভিক্টরিও যুগের ঐতিহাসিকেরা ছিলেন রীতিমতো বিভ্রান্ত – কেউ মনে করেছেন এই হিরেটি হারিয়ে যাওয়া বাবরের হিরে। কারোর ধারণায় এই হিরেটিই হলো কোহিনূর। তিন সূত্রে তিন ধরণের ওজনের কথাও বিভ্রান্তিকর। তবে এটি যদি সত্যি বাবরের হারিয়ে যাওয়া হিরে হতো, তাহলে কি মীর জুমলা যথেষ্ট আড়ম্বর সহকারে এই ঘটনার প্রচার করতেন না? তিনি ছিলেন জাত ব্যবসায়ী, ‘বাবরের হিরে আমার কাছেই আছে আর আমি এটা মুঘলদেরই ফিরিয়ে দিলাম’ এই প্রচারণায় তাঁর রত্ন-ব্যবসা অবশ্যই ‘এক্সট্রা মাইলেজ’ পেত। তাই মনে হয়না, এটি সেই বাবরের হারিয়ে যাওয়া হিরে।
পরবর্তী পর্বে থাকবে ময়ূর সিংহাসন যা কিনা মুঘল রত্নাসক্তির ‘ক্লাইমেক্স’..পড়তে থাকুন,পড়াতে থাকুন..
©️শঙ্খচিল
[ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত, মনে করা হয় এটিই শাহ জাহানের রত্নখচিত পান্নার লেন্সের চশমা। সংগ্রহকাল, ঊনবিংশ শতাব্দী। এই চশমার নাম ছিল ‘Astaneh-ye Ferdaws’ বা স্বর্গোদ্বার। এর থেকে বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি।]
[…] ৪. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-4/ […]
[…] ৪. saabdik.com/kohinoor-mistry-part-4/ […]