কবিকথা ও প্রেম

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
2580 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

(পর্ব- ১)

কেবল জন্মদিন আর মৃত্যুদিন ছাড়াও বেশিরভাগ বাঙালি তাঁকে সারা বছর মনে রাখেন। রাখতে বাধ্য হন।হাজার গুণ বেশি করে মনে রেখেছি তাঁর প্রেমিকসত্বা..বাঙালি পড়তে ভালবাসে,মনে পড়তে ভালবাসে।তাই কয়েকটি বিশেষ পর্বের মধ্যে দিয়ে রবি কবিকে নিয়ে চর্চা আজ থেকে শুরু করলাম..কেমন লাগছে জানাবেন..আজ তার প্রথম পর্ব..

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যকে যিনি তার অমর সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনোন্য উচ্চতায়, কালজয়ী গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার থেকে যিনি ধীরে ধীরে তাঁর কাব্যপ্রতিভার মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছেন “বিশ্বকবি”….. তাঁর জীবনেও প্রেম এসেছে দুর্বার গতিতে, এবং তা কেবলমাত্র একবার নয়… একাধিক বার।

ব্যক্তিজীবনে সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনাথ প্রেমের জন্য মরিয়া ছিলেন। স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গে তো বটেই, জীবনে বেশ কয়েক বার প্রেমের উত্তাল সমুদ্রে ভেসেছেন বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ লিখেছেন এবং যত ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে লিখেছেন, তাতে তাঁকে কোন এক বিশেষ ধরণের কবি অথবা সাহিত্যিক বলা সম্ভব নয় ; যেমন প্রকৃতির কথা প্রচুর লিখলেও তাঁকে প্রকৃতির কবি বলে আখ্যায়িত করা সম্ভব নয়। তবে যে তিনটি বিষয়বস্তু তাঁর রচনায় বার বার করে ফিরে এসেছে, তা হল প্রকৃতি, প্রেম ও পূজা। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার কথা মনে রাখলে লক্ষ্য করা যায় যে, বয়স যত বেড়েছে ততই তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে মানুষের ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
গানে তিনি বারংবার নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় আর সান্ত্বনা খুঁজেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে যদি কোনো এক বিশেষ ধরণের শিল্পী বা কবি বলে
চিহ্নিত করতেই হয়, তাহলে সম্ভবত প্রেমের কবি বা শিল্পী বলাই ভালো। কারণ, প্রেম কেবল তাঁর শত শত কবিতায় আর গানে শুধু প্রকাশ পায়নি…. তাঁর প্রকৃতি এবং পূজাও প্রেমের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এই ভিন্ন ধরণের বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় না।

তবে রবীন্দ্রনাথ এর প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিল অনেক বেশী। তিনি বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, যার সাথে আবার মিশেছিল ব্রাহ্মরুচি… বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন উদারপন্থী হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার কবরটির সংস্কার করা দূরে থাক, কেনসাল গ্রিনে একবার গিয়ে দেখেও আসেননি মনে হয়। সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, প্রিন্স দ্বারকানাথের সমস্ত ব্যবসায়িক কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ হেন রুচি ছিল তাঁর। তাঁর প্রেম হল কামান্ধ নাহি তায়…!!

রবীন্দ্রনাথ দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রঙ ইউরোপীয় দের মত। তার মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের সদস্য। সবার ওপর তাঁর পরিচয় তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সব কিছু মিলিয়ে তিনি কত নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন, তা বোধকরি আজ আর সঠিক ভাবে জানা সম্ভব নয়।

যে বালিকার প্রেমে প্রথম তিনি পড়েন, তিনি তাঁর অন্যতম বড়ো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। সেই বাল্য ও কৈশোরের প্রেমে অবশ্য কোন দেহের যোগাযোগ ছিল না। এখন একুশ শতকের গোড়ায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম সম্পর্কে যে দৈহিক অনুষঙ্গ তৈরী হয়েছে, সেই প্রেমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই প্রেমের কোন মিলই ছিল না। কাদম্বরী দেবী ছিলেন তাঁর প্রথম খেলার সাথী, এরপরে সাহিত্যের পথপ্রদর্শক, বন্ধু, প্রথম পাঠিকা ও সমালোচক, তার পথের দিশারী। এমনকি এক পর্যায়ে কৈশোরক প্রণয়ও দেখা দিয়েছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে। একদিকে ব্যক্তিগত জীবনে কাদম্বরী দেবী ছিলেন গভীর দুঃখে দুখী। বিবাহিত সম্পর্কের টানাপোড়েনের দরুণ তিনি কোনোদিনই কোন সম্মান পাননি ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে। কাদম্বরী দেবীর গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। সেই তুলনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চেহারা ছিল রাজপুত্রের মতো। বধূ হিসেবে তাকে অন্য বউয়েরাও মেনে নিয়েছিলেন, কারণ দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ ছিল সকলের কাছে বেদবাক্যের মত, অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু অন্য বউয়েরা তাঁকে কখনো নিজেদের জা হিসেবে মন থেকে মেনে নেননি। সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, যিনি ছিলেন বিলেত ফেরত এবং ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম সিভিলিয়ানের স্ত্রী। অতি আধুনিকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এদিকে ভক্ত ছিলেন এই আধুনিকার। ভক্ত না বলে মোহগ্রস্ত বলাই ভালো। নিজের বউ এর দিকে খানিকটা মনোযোগ দিয়েছিলেন, কাদম্বরী দেবী যখন উদ্ভিন্নযৌবনা, এবং তাও স্বল্প সময়ের জন্য। নয়তো বাড়িতে ফিরতেন না। কাদম্বরী দেবীর সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দৈহিক মিলনও হতো না, অথবা হলে হতো ব্যতিক্রম হিসেবে। তাঁকে বন্ধ্যা বলে আখ্যায়িত করা হতো কোন ডাক্তারী পরীক্ষা ছাড়াই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে তিনি যে গৃহের দিকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না, তার জন্য সকলেই বউয়ের দোষ দিতেন ; বিশেষ করে ঠাকুর পরিবারের মহিলারা। কারণ, পুরুষদের সাত খুন মাফ। কাদম্বরীর নিঃসঙ্গতা, হতাশা, রবীন্দ্রনির্ভরতা সব কিছুর কারণই ছিল এসব।

মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সমালোচক হেনরি জেমস (১৮৪৩ – ১৯১৬) লিখেছেন যে, একজন কবি অথবা সৃজনশীল সাহিত্যিক যা কিছু লেখেন, তার প্রতিটি পংক্তিতে নিজের কথাই লেখা থাকে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ঠিক এর উল্টো কথা….

“কবিরে পাবে না তাঁহার জীবনচরিতে…”

অবশ্য একথা লিখলেও তিনি বার বার নিজের কথাই লিখেছেন। বিভিন্ন ভাবে, নানা আঙ্গিকে, কবিতায়, গানে, উপন্যাসে, নাটকে, এমনকি প্রবন্ধে ও নিজের আঁকা ছবিতে। ব্যক্তিগত জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বারংবার অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর সেই নিবিড় এবং প্রগাঢ় অভিজ্ঞতাই তাঁকে অতখানি উদ্বুদ্ধ এবং উচ্ছ্বসিত করে তুলেছিল লিখতে।

তিনি তাঁর ভিতরকার সত্ত্বা, এই ‘আমি’টিকে বড্ড ভালোবাসতেন। আর তাই তিনি লিখেছিলেন –
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে…. ”

মূল বিষয়টা থেকে একটু সরে এলাম ভাবতে পারেন।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর জীবনে প্রেম কে সঠিকভাবে জানতে গেলে এই প্রসঙ্গটুকুর অবতারণার প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি।

©️শঙ্খচিল

ক্রমশঃ

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল