আমি সাধারনত ফিল্মরিভিউ করিনা, আর ইদানিং একটা অন্য কাজে ইনভল্ভ হয়ে গিয়ে তেমন কিছু আর লিখছিও না৷ কিন্তু এই সিনেমাটা দেখার পর মনে হল যেন বাকি রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেব৷ ও হ্যাঁ, এখন যখন লিখছি তখন ঘড়িতে সময় রাত্রি তিনটে পঁয়ত্রিশ!
মুলত দুই ভাইয়ের মানসিক দূরত্ব, কিছু চাপা অভিমানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া রাগ আর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে দাঁড়িয়ে মুল গল্প৷ গল্পের নামেই বুঝতে পারছেন, পরিবারের বড়ছেলে কেন্দ্রীক এই সিনেমা যেখানে দেখানো হয়েছে ‘বড় ছেলে’ ব্যাপারটা জাষ্ট একটা অধিকার নয়! বড় ছেলের কিছু কর্তব্য থাকে! বড় ছেলের কিছু দায়ীত্ব থাকে পরিবারের প্রতি! যখন বড় ছেলের সেই দায়ীত্ব কর্তব্য গুলো ছোট, মেজ, সেজ, অথবা অন্য কোন ছেলে করে তখন আগে না জন্মেও সে ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ হয়ে যায়! তাই ‘জ্যেষ্ঠপুত্র কোন অধিকার নয়’৷
সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে গ্রাম্য দৃৃশ্যগুলো ভীষণ পরিচিত, আসলে এই পরিবেশেই থাকি তো তাই আলাদা করে আর আকর্ষণ তৈরী হয়নি দৃৃশ্যপট নিয়ে৷ তাই নজর ছিল গল্প আর অভিনয়৷
অভিনয়ের দিকে আসি৷ বহু দিন পর সুদীপ্তা কে দেখলাম অভিনয় করতে, আহা মনে ভরে গেল! সত্যি কথা বলতে কি একটা সময় মনে হয়েছিল সুদীপ্তার পরিবর্তে অপরাজিতা আঢ্য হলে মন্দ হত না, কিন্তু সিনেমা দেখা শেষ করে মনে হল ঐ চরিত্রে সুদীপ্তার পরিবর্তে আর কেউ আসতে পারতো না! বহুদিন পর গার্গী কেও দেখলাম! স্বল্প পরিসরে এত প্রাকৃতিক অভিনয় করার ক্ষমতা খুব কম জনেরই আছে৷ ভীষণ ভালো লেগেছে শ্রেয়া দামিনীর অভিনয়ও৷ প্রসেনজিতের কথা বলার ধৃষ্টতা করলাম না! শুধু সারাটা মানসপট জুড়ে ঋত্বিক চক্রবর্তী রাজ করে বেড়াচ্ছে! শুধু ঋত্বিকের অভিনয় দেখার জন্যই আরও একবার দেখলাম সিনেমাটা৷
কিছু চোখা চোখা সংলাপ আজীবন মনে রয়ে যাবে! বিশেষ করে দুই ভাইয়ের এক ফ্রেমে সেই দৃৃশ্য যেখানে প্রসেনজিৎ বোঝাচ্ছে ব্লাডব্যাঙ্ক ইন্ডাস্ট্রির সাথে তার রক্তের ভাইয়ের সম্পর্কে তুলনা! উফ্ , জাস্ট অসাধারণ৷ ‘আমি যে সুপারস্টার হয়ে গেছি, এটা কি আমার দোষ বল?’
মিত্রা আর মিত্রর ঠোক্করে গাগ্রীদেবীর উক্তি, ‘বাঙালি তো! তাহলে আমাকে দেখে তোমার কি কারণে ইংরেজি বলতে ইচ্ছে হল?’ অনবদ্য৷
‘দিদিমনির চোখ! খাতা খুললেই ভুলগুলোই আগে ধরা পড়ে’, শিক্ষক হিসেবে নিজেকে ভীষণ রিলেট করতে পারলাম৷
ও হ্যাঁ, পারুলের চরিত্র কি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে একজন বিবাহিতা স্ত্রীর চোখে তার স্বামী আর পুরানো প্রেমিকার প্রতি টানের ফারাক! পুরানো সম্পর্কে তীব্র আকর্ষণ বোধ করার পরেও চোখে জল নিয়ে স্বামীর প্রশংসা একমাত্র বাঙালি বধুই করতে পারে! ‘ভেবো না যে আমার বর আমাকে ভালো রাখে না! ও বেস্ট!’
দিদিমনির ভুল সংশোধনের চেষ্টা ‘স্টারদের জীবনে এসব ছাপার ভুল, বানান ভুল ফ্যাশন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়’ এর মাধ্যমে থাপ্পড় পড়ল বোধয় বই ব্যবসায়ীদের গালেও!
আরও যেটা দেখলাম, বেশ কয়েকটা থাপ্পড় সজোরে লাগিয়েছেন পরিচালক৷
প্রথমত কিছু আতাক্যালানে পাবলিক! স্টার দেখলেই জাঙ্গিয়া তুলে ছুটে আসে, যেগুলো সাধারণত আমাদের মধ্যেই আশে পাশে হাজারো ঘোরাঘুরি করছে, তাদের এই বিকৃৃত মানসিকতাটা দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে! স্কুলের শোকসভায় যখন জৈষ্ঠপুত্র গান ধরলেন, ঠিক তার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত ভয় করছিলাম এই না কেউ দর্শকাসন থেকে বলে বসে, ‘গুরু, একটা লাচের গান হোক’! অবশ্য আশা মিটিয়ে দিয়েছে কাছারি বাড়িতে, ‘দাদা একটা ডাইলগ হবে নাকি?’ আসলে এই পাবলিকগুলো এই রকম সিচুয়েশনে ডেডবডির গলাতেও ফুলসজ্জার মালা পরিয়ে সাতপাক ঘুরিয়ে দিতে পারে!
আর দেখলাম কিছু হরিদাসপাল শিক্ষকমশাইকেও! হ্যাঁ, এগুলো আমাদের ভীষণ পরিচিত চরিত্র, আমাদের আশেপাশেই প্রতিনিয়ত জ্যান্ত ঘুরে বেড়ায়৷ পরিচালক ব্যতিক্রমী চরিত্রায়নগুলি দারুণ ভাবে তুলে ধরেছেন৷ একদিকে ধীর স্থির শিক্ষিকার চরিত্রে গার্গী, সাথে বয়স্ক দুজন শিক্ষক যারা স্মরণ সভায় বক্তৃতা রাখছিলেন! আর ঠিক তাদের পাশেই দুই শিক্ষক, বয়স্ক মানুষটির আবেগ কে মাঝপথে থামিয়ে অসভ্যের মত মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে হুল্লোড়ে মেতে উঠলেন স্টার এসেছে বলে! আসলে এদের বিবেকবোধ বা মূল্যবোধ কিছু নেই, যেটুকু আছে তার অনেক ওপরে দেখনদারীর পর্দা ঠাসা! এরকম আছে, আছে এরকম অনেকেই যারা একটু উঁচু আসনের কাউকে দেখলেই নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে লুলুপুষু মার্কা আচরণ করতে থাকেন নির্লজ্জের মত৷
নাটক, থিয়েটার আর সিনেমা নিয়ে তুলনামুলক আলোচনাটা দারুণ লেগেছে৷
সবে মিলিয়ে আবারও একটা কমপ্লিট বাংলা সিনেমা দেখলাম! ভীষণ ভালো লাগছে যে বাংলায় এই ধরনের সিনেমা তৈরি হচ্ছে, ভয় লাগছে যে এগুলো মফঃস্বলের সিনেমা হলে চলবে না৷ যাইহোক, আমারও মনে হল যে সিনেমা হলে নয়, এই সিনেমাটা অন্ধকার ঘরে একা বসে কানে হেডফোন নিয়েই দেখতে হয়৷
আর হ্যাঁ, বাড়িটা যখন ‘দেশের বাড়ি’ হয়ে যায় তখন বাড়ির প্রতি টান ভীষণ বেড়ে ওঠে! কিন্তু দেশে থেকে নিজের বাড়ি, ব্যাপারটা অনেক সময় সুখের হয় না!
©DipenBhunia, চন্দ্রকোনা৷
চিত্র সৌজন্য : গুগল