সময়টা ১৯২৯ এর জুন মাস। লাহোর জেলা আদালতের বাইরেটা সেদিন লোকে লোকারণ্য। পুলিশ ক্রমাগত লাঠি উঁচিয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে।আর অকুতোভয় জনগন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠছে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ই-ন-কি-লা-আ-ব জিন্দা-আ-আ-বা-আ-আ-দ।” সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ধ্বনিতে আকাশ বাতাসের মতোই কেঁপে উঠছে ব্রিটিশের অন্তর।উদ্দীপ্ত অকুতোভয় জনগনের এই আবেগের ঢেউ সামলাবে কি ভাবে পুলিশ,তাই ভেবে তারা দিশাহারা? আর আদালতের ভেতরে তখন একপাল তাজা প্রান দাঁড়িয়ে আছে কাঠগড়ায়। চোখে মুখে ঠিকরে বেরোচ্ছে দেশপ্রেমের আগুন। নির্ভীক উদ্যত আত্মবিশ্বাসী সেই চোখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছেনা সরকারী উকিল বা মহামান্য জজের। দেশীয় পুলিশকর্মীরা তাদের বিদ্রুপ ব্যঙ্গের মুখে পড়ে অসহায় ভাবে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। কে বলবে এই যুবক দল স্যান্ডারস হত্যা ও লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী। ফাঁসি যাবজ্জীবন বা দ্বীপান্তরের শাস্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তার ভয়ের লেশ মাত্র নেই এই দামাল সন্তানদের চোখে মুখে।
এমন সময় গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালো এক কালো প্রিজন ভ্যান। হাতে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় পুলিশ আদালতের ভিতরে নিয়ে এলো ধুতি শার্ট আর চশমায় সজ্জিত এক বাঙালী যুবককে। তাকে দেখেই কাঠগড়ার মধ্যে থেকে চিৎকার করে উঠলেন বটুকেশ্বর,আরে যতীনদা যে, একবারে সাতপাকে বেঁধে জামাই আদরে আনলো যে। কেমন আছো দাদা? আর ওই তেজি উদ্দীপ্ত ছেলেটা, ভগৎ সিং, চিৎকার করে উঠলো, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, যতীন দাস জিন্দাবাদ।তার সাথে গলা মিলিয়ে যুবকের দল স্লোগানের ঝড় তুলল।আর বাইরের জনগন তাতে গলা মিলিয়ে তৈরি করলো সমুদ্রগর্জন। চাপা পড়ে গেলো উকিলের গলা,জজের হাতুড়ি ঠোকা সব। যুবকেরা বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানালো বাংলার বিপ্লবী যতীন দাসকে।
হইচই থামলে সরকারি উকিল ঘোষণা করলো,বোমা তৈরি করা,বোমা সরবরাহ করা,ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষন দেবার অপরাধে কলকাতার যতীন দাস কে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার সাথে যুক্ত করা হোল। আদালতে ঘোষিত হোল তাঁর কেসহিস্ট্রি।
যতীন্দ্রনাথ দাসের জন্ম কলকাতায় ১৯০৪ সালে ২৭ অক্টোবর। তাঁর পিতার নাম বঙ্কিমবিহারী দাস। ১৯২০ সালে ভবানীপুর মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কংগ্রেসের সদস্য হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন।১৯২৩ সনে বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কলকাতার ভবানিপুরে ঘাঁটি করলে তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দেন। পরে দক্ষিণেশ্বরের বিপ্লবী দলের সংগেও তাঁর যোগাযোগ হয়। ১৯২৪ সালে দক্ষিণ কলকাতায় “তরুণ সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সময় গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা জেলে প্রেরিত হন। জেল কর্তৃপক্ষের আচরণের প্রতিবাদে ২৩ দিন অনশন করেন।শেষ পর্যন্ত তাঁর আন্দোলনের চাপে মাথা নত করে জেল কর্তৃপক্ষ। বিপ্লবীরা পান রাজবন্দীর মর্যাদা। জেল খেটেও তাঁর বিপ্লবের আগুন নেভেনি।তা পরিনত হয় দাবানলে। তিনি বোমা তৈরির ফর্মুলা শিখে তাতে প্রশ্নাতীত দক্ষতা অর্জন করেন। পাঞ্জাবে এসে নওজোয়ান ভারত সভার সদস্যদের সহজে ও সস্তায় মারাত্মক বোমা বানানোর পদ্ধতি শেখান। ভগত সিং আইনসভায় যে বোমা নিক্ষেপ করেছে সেই বোমার ফরমুলা ইনারই শেখানো।মূলত এর জন্যই আজ লাহোর সহ সমস্ত পাঞ্জাবের ঘর গুলি বোমা তৈরির আঁতুড় ঘরে পরিনত হয়েছে। তাই মহামান্য আদালতের কাছে এই আসামির চরমতম শাস্তির দাবী জানানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।
লাহোর জেলে ভগত,সুখদেব,রাজগুরু,বটুকেশ্বর দত্তদের সাথে স্থান হয় যতীন দাসের। জেলের পরিবেশ দেখে দেখে তিনি বাকরুদ্ধ। বন্দীদের পোশাক অপরিচ্ছন্ন, পচা খাদ্য দেওয়া হচ্ছে, ইঁদুর আরশোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারে,সাধারন চোর ডাকাত অপরাধীদের সাথে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক বন্দীদের। মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে তাঁর। রাত্রের খাবার দিতে এলে ছুঁড়ে ফেলে দেন থালা।ভগতের সাথে পরামর্শ করে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জেল সুপারের সাথে কথা বলতে চান। পরদিন জেল সুপার আসেন। কি হে ছোকরা, তোমার আবার গুসসা কিসের? কী রাজভোগ চাই তোমার? যতীন দাস জানিয়ে দেন জেলের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ চাই,এই নোংরা খাবার তিনি মুখে তুলবেন না। রাজবন্দীদের পৃথক মর্যাদা চাই তাঁদের। সব বিপ্লবীরাই একযোগে জানিয়ে দেন, তাঁরাও সামিল হবেন অনশনে। ব্যাঙ্গের হাসি হেসে চলে যান সুপার,দেখি তোদের কতো দম।
ভগত সিং আর যতীন দাস সকলের সাথে আলোচনায় বসেন। অনশন হল দাবী আদায়ের এক চরম ও কঠিনতম পদ্ধতি।বন্দুক পিস্তল নিয়ে লড়াই করার চেয়ে ঢের কঠিন এই তিলে তিলে নিজেকে শেষ করা। ঢাকা জেলের ২৩ দিন অনশনের অভিজ্ঞতা থেকে দাস বললেন, জেল কর্তৃপক্ষ অনশন ভাঙানোর জন্য প্রবল অত্যাচার করবে, কেউ অনশন ভাঙলে সেটা সবারই পরাজয়। তাই আবেগে নয়, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত যারা অসুস্থ, তাদের বাদ দিয়ে বাকিরা অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। দাবী পরিচ্ছন্ন পরিবেশ,স্বাস্থ্যকর খাদ্য,জেলে কাজ না করানো, জেলে খবর কাগজ বইপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করা।
প্রথম ২/১ দিন জেল কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করলো। ২,৩দিন গড়িয়ে যাওয়ার পর দাবানলের মতো খবর ছড়াতে লাগলো বাইরে। মিছিল বিক্ষোভ শুরু হোল পাঞ্জাব লাহোর বাংলা জুড়ে। জেল কর্তৃপক্ষ জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করলো। চাবুক, লাঠির আঘাতে জর্জরিত করলো তাদের।ক্ষতবিক্ষত বিপ্লবীদের জল দেওয়া বন্ধ করলো, আগে খাদ্য নে তারপর জল। সাঁড়াশি দিয়ে মুখ খুলিয়ে ঢুকিয়ে দিলো খাবার। থু থু করে ফেলে দিলো তারা। শুরু হোল অনশন ভঙ্গ করলে মুক্তি দেবার লোভ দেখানো। কিন্তু তাঁরা অটল। দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে গেলেন অনশন।জিন্নার নেতৃত্বে লাহোরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল শুরু হোল, জওহরলাল এসে দেখা করলেন অনশনকারিদের সাথে। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে ইংল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়ল এই খবর।বড়লাট আরউইন ছুটে এলেন লাহোরের কমিশনারের সাথে কথা বলতে। ততদিনে পেরিয়ে গেছে ৫০দিন। সুভাষচন্দ্র বার্তা পাঠালেন তাঁদের সমর্থন করে। তাঁর নেতৃত্বে ভারত জুড়ে শুরু হোল তীব্র প্রতিবাদ ধিক্কার মিছিল। জেল কর্তৃপক্ষ অনড়। এই অবস্থাতেও স্ট্রেচারে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল তাঁদের। ভগতের ওজন কমে গেলো ৬কেজি।
এদিকে যতীন দাসের শরীর ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করলো। ইউরিনে আসছে রক্ত, কিটোন বডি বিপদ সীমা পার করেছে। মাথা তোলার ক্ষমতা নেই, ক্ষয় রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে,কাশির সঙ্গেও রক্ত উঠছে।জেলের ডাক্তার চিন্তিত হয়ে তাঁকে মুক্তির সুপারিশ করলেন।কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই ভয়ঙ্কর বিপ্লবীকে মুক্তি দিতে রাজি নয়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন দাস।কারন তিনিও এই সঙ্গীদের ফেলে বাইরে যেতে রাজি নন। আস্তে আস্তে কথা জড়িয়ে যেতে লাগলো তার।আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইলেন। ভগত অনুরোধ জানালেন অনশন ভেঙে দিতে। তেমন হলে সবাই অনশন প্রত্যাহার করবেন। দপ করে জ্বলে উঠলো দাসের চোখ। স্মরন করিয়ে দিলেন সেই প্রথম দিনের কথা, কোনোমতেই দাবী না মানা পর্যন্ত অনশন না ভাঙার শপথ। হাল ছেড়ে দিলেন সবাই। তারপরের কয়েকটি দিন শুধু দিন গোনা।কখন আসবে সে। মৃত্যুর করাল থাবা গ্রাস করবে তাদের প্রিয় যতীনদাকে। সবার চোখে জল। তাকানো যাচ্ছেনা তাঁর দিকে। কিন্তু তাঁর মুখে অম্লান হাসি। যে হাসিতে বুঝিয়ে দেওয়া দেশের জন্য হাসিমুখে প্রাণত্যাগের সংকল্প। যে হাসিতে দেখিয়ে দেওয়া ভারতবাসির দম।
১৩ই সেপ্টেম্বর,১৯২৯। অনশনের সেদিন ৬৩ তম দিন। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছেন যতীন দাস। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছেন। চোখ খুললেন দাস, হাত নেড়ে ডাকলেন ভগত, সুখদেব, বটুক সহ সমস্ত বিপ্লবীদের। বললেন আমি চললাম, তোমরা থেকো,বুকে থাকুক বিপ্লবের আগুন,জয় আমাদের হবেই,আমাদের ত্যাগে আজ দেশ জেগে গেছে,আমি চললাম কিন্তু জেলের বাইরে জেগে উঠেছে কোটি কোটি যতীন দাস,এইটাই আমাদের জয়।অতি কষ্টে ক্ষীণ কন্ঠে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা ব্যাক্ত করে গেলেন, নৈষ্ঠিক শাস্ত্র বিশ্বাসী বাঙালী ফ্যাসনে আমাকে কালীবাড়ী নিয়ে যাওয়া বা অন্যান্য সৎকর্ম করিও না। আমি একজন ভারতীয়। আমি কেবল বাঙালীর নই।আমি কেবল হিন্দুর নই। আমি দেশবাসির।” চিরঘুমের দেশে তলিয়ে গেলেন তিনি।মাত্র ২৪ বছর বয়েসে ঝরে গেলো একটি তাজা প্রান,শুধুমাত্র দেশের কথা ভেবে। স্তব্ধ হয়ে গেলেন বিপ্লবীরা। ভগত সিং বলে উঠলেন,ইনকিলাব জিন্দাবাদ,যতীনদা জিন্দাবাদ। কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে গেলো তাঁর।
সারা দেশ জুড়ে আগুন জ্বলে উঠলো তাঁর বলিদানের খবরে।ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নড়েচড়ে উঠলো এতদিনে। জরুরী রিপোর্ট তলব করা হল বড়লাটের কাছে। সুভাষচন্দ্র ছুটে এলেন তাঁর মরদেহ কলকাতায় নিয়ে যেতে। সজল নয়নে তাঁকে চির বিদায় দিলেন লাহোর জেলের বিপ্লবীরা,তাঁর শেষ কদিনের প্রানের বন্ধুরা। লাহোর থেকে হাওড়া আসার পথে ৫৭ বার জনগন থামিয়ে দিলো ট্রেন। একবার দেখতে চায় তাদের প্রিয় নেতাকে। আবেগে ভেসে গেলো ভারতবর্ষ।
হাওড়া থেকে জনতার কাঁধে চড়ে শ্মশান যাত্রা শুরু হল।সমস্ত বাধা ভয় দূর করে ২লক্ষ মানুষ সামিল হল মিছিলে। শেষযাত্রার পুরোভাগে রইলেন বাংলা মায়ের আরেক দামাল ছেলে সুভাষচন্দ্র। শ্মশানে শায়িত মরদেহ। দুইজন যুবকের কাঁধে ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলেন বঙ্কিমবিহারী বাবু। হাঁটু মুড়ে বসলেন পুত্রের সামনে। আদরের খাঁদুকে মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে পরম যত্নে আদর করলেন। চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়লো ক ফোঁটা জল। অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, “ওঁ নারায়ণ, যে দেশদ্রোহিরা মাতৃভুমিকে বিদেশীর হাতে সমর্পণ করেছিল, তাদের সকলের প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ আমার আদরের খেঁদুকে অশ্রু অর্ঘ সহ তোমার চরণে সমর্পণ করলাম। ওর স্বপ্ন যেন পূর্ণ হয়।”
পূর্ণ হয়েছে তাঁর স্বপ্ন। দেশ হয়েছে স্বাধীন। কিন্তু এ কোন দেশ! যে দেশের জন্য তিনি না খেয়ে জীবন বিসর্জন দিলেন, সেই দেশ আজ শুধু করে খাওয়ার নেশায় মত্ত। একটা অংশ সর্বগ্রাসী নীতি নিয়ে গ্রাস করছে সম্পদ সুযোগ সমাজ শিক্ষা চেতনা আদর্শ সব কিছু। আর একটা অংশ আজও ডুবে রয়েছে অনাহারে ক্ষুধায় অশিক্ষায় দারিদ্রের অন্ধকারে।
আজ 27 অক্টোবর, কালীপুজো। আজ সেই মহামানবের জন্মদিন। দীপাবলির আলোকে যেন অন্ধকারে ডুবে না যান এই বীর নায়কেরা। তারা উজ্জ্বল থাকুন আমাদের চেতনায়, মননে, আদর্শে। প্রণাম জানাই বীর বিপ্লবী যতীন দাসকে। জয় হিন্দ।
,,,,পার্থ চক্রবর্তী
তথ্য সূত্র- আধুনিক ভারতের ইতিহাস-জীবন মুখোপাধ্যায়, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, উইকিপিডিয়া।
চিত্র সৌজন্য : গুগল