গহন

চৈতালি দে
4.1 রেটিং
1589 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 14 , গড়ে : 4.1]

পাঠকদের পছন্দ


হঠাৎ একটা শূন্যতা গ্রাস করলো নন্দিনীকে। বেশ দীর্ঘ একটা কর্মজীবনের ইতি আজ সে টানল। একটু আগেও ঘরটা গমগম করছিল হাসি, মজা আর আনন্দে। তার অফিসের সকলে তাকে ছাড়তে এসেছিল বাড়ীতে একরাশ উপহারসহ। সবার চলে যাওয়ার পর হঠাৎ নৈশব্দটা অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে তার। অথচ এই একই ঘরে একাই সে কাটিয়েছে শেষ চারটে বছর। স্বামীর মারা যাওয়া, ছেলের বিদেশে ভাল চাকরি তাকে একা করে দিয়েছে এই এতবড় বাড়ীতে। কই এতটা শূন্য তো লাগেনি। নাকি সবই মনের ব্যাধি।
নন্দিনী একজন কর্মব্যাস্ত মেয়ে। অবশ্য এই চারটে বছরের জীবনটাকে আর মেয়েবেলা বলা ভুল হবে। সমস্ত দায়িত্ব বা দায় সবই সে একার হাতে সামলেছে ঘরে বাইরে। স্বামী অসময়ে চলে যাওয়ার পর ছেলের সমস্ত বায়না, আবদার বা প্রয়োজনের সমস্ত সমাধান হয়ে উঠেছিল সেই। নিজেকে কোনদিন দুর্বল বলে মনে তো হয়নি তার। সবাই মজা করে বলে যে ওর হাতে নাকি “ম্যাজিক স্টিক”। যাতে ছোঁয়ায় তাতেই সোনা ফলে। তাও নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো সে ব্যালান্স করেছে বাকীদের চাহিদার সাথে। যতটুকু চেয়েছে ততটুকু নির্বিঘ্নে পেয়েছে সে। মাটি ছেড়ে ওড়ার আকাঙ্ক্ষা হয়নি কোনদিন।
তবু আজ ওর এই দিনটা কেমন যেন বেসুরো লাগছে। তাহলে কি আজকের অবসর  হঠাৎ করে তাকে বার্ধক্যে এনে পৌঁছে দিল?এমন হাজারটা ভাবনা তো অনেক খারাপ সময়ের মধ্যেও তাকে গ্রাস করেনি। তাহলে কী সে সত্যিই বুড়ো হয়ে গেল? একদিনেই? কয়েক ঘণ্টায়? না, না, হয়ত এসব ভাবনা তার অবসর বা অবকাশের বিলাসিতা। কাউকে নিয়ে আজ আর তার কোন ক্ষোভ, রাগ, অভিমান নেই। সব আবেগই সংযত হয়েছে বয়স বাড়ার সাথেই।

কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার সবথেকে বড় ভাবনা হয়ে উঠলো সে নিজে। জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে সত্যি কি নিজেকে নিয়ে হিসেব কষার খুব দরকার ছিল? তাও খুঁজতে থাকলো।
আচ্ছা নন্দিনীর সত্যি ‘আমি’ কোনটা? জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আজ ও কি সে চিনতে পেরেছে নিজেকে? জানতে চেয়েও, খুঁজতে চেয়েও, বুঝতে চেয়েও জানিনা কেন তার এই ‘আমি’টা কীভাবে অধরাই থেকে গেছে। যে নন্দিনী নিজেকে ধরতে পারেনি আর কেউ বা কারা তাকে ধরে ফেলবে, তার ভালো মন্দ সব তাদের চোখের সামনে বইয়ের খোলা পাতার মতো হবে তা সে মানতে পারেনি কোনদিন। তাই একটা কঠিন মোড়কে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে। বাইরের আর ভেতরের ‘আমি’ দুটোকে আলাদা করে রেখেছে সযত্নে।

সেই কোন ছোট থেকেই তো এই ‘ছোট্ট’ আমি কে সযত্নে লালন করেছে, সবার সামনে ওকে সুদৃশ্য, সঠিক করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। বাইরের এই সুন্দর ‘আমি’ টা আসলে নন্দিনীই তো। কোথাও মনের গোপনে কোন একটা কোনায় কখনো কী একটু অগোছালো হয়নি সে? একটুও দুষ্টুমি ভর করেনি কখনো? হয়েছে তো এমন। কিন্তু ‘আমি’ যে আদর্শ হব, শুধু নিজের কাছে না, চারপাশের সকলের জন্য। সেই ছোট্ট ‘আমি’ আস্তে আস্তে পালটেছে অনেকটা। নিজের ভালো লাগার সাথে জুড়েছে বাকীদের চাহিদা।

যে নন্দিনীর ‘আমি’ টা সামান্য, তুচ্ছ ব্যাপারেই অগাধ খুশির সাগরে ডুবত, অভিজ্ঞতার ভার কেমন তাকে পালটে দিল। কীভাবে যে তিলতিল করে একটা লজেন্সে খুশী হওয়া নন্দিনী পাঁচ অঙ্কের মাইনেতেও আর খুশী হয়না তা সে নিজেও জানেনা। তার সেই ছোট্ট ‘আমি’ ঘিরে ছিল অনেক স্বপ্ন, আশা। সেগুলো যে কবে নষ্ট হল বা সেগুলো হয়তো শুধুই স্বপ্নই ছিল। বাস্তবের ঘাত- প্রতিঘাত তার ঐ ‘আমি’টা কে অনেক বড় করে দিয়েছে কয়েকটা খাটা দিন, মাস বা বছরের ব্যবধানে। যে ছোট্ট মেয়েটি বাবার ফিরতে দেরী হলে ফুঁপিয়ে কাঁদত সেই নন্দিনী বাবাকে হারিয়ে বেশ ভালই তো আছে। রোজকার দিনযাপনে কই রোজ মনেও পড়েনি এই কাজের স্তূপে। স্তূপ সরিয়ে রোজ কি বের করা হয় স্মৃতিগুলো? তাও তো সে ভালই আছে। যাদের সাথে ছোট থেকে খেলা, আনন্দ, অভিমান, ঝগড়া আর আড়ির জীবন কাটিয়েছে , যাদের ছেড়ে থাকার সহজ সমাধান খুজেছে একই বাড়ীতে বিয়ের মধ্যে, আজ তারা ভিড় করে শুধু মুঠোফোনে। কই মনে তো আজ তারা ভিড় করে না। তাহলে ঐ ‘আমি’ টা কী অনেক বড় হয়ে গেল? আর সাথে অনেকটা নিষ্ঠুর, কঠোর স্বার্থপর? এ কেমন নন্দিনী? নিজেকেই আজ অনেকটা সময় অচেনা লাগে। কবে হল সে এমন? হঠাৎই নাকি সময়ের গতিতে? বড় হওয়ার, অভিজ্ঞ হওয়ার একান্ত শর্ত কি এগুলো? তাও মানতে এত বাঁধছে কেন জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে?

 

স্বামীর মৃত্যুতে শোকযাপন না করে লেগে পড়েছে কর্তব্যের পাহাড় চড়তে। যে ছেলেকে ছেড়ে একটা রাতও একা থাকেনি, তার দূরে থাকাটাও সে মেনে নিয়েছে। কই শুরুর কষ্ট আজ তো আর সে বোধ করে না।

কিন্তু না, ঐ অতীত ‘আমি’ টা আছে বলেই আজ সে ফিরে যায় স্মৃতির পাতায়। কী আর করা? এই গোটা ‘আমি’ টা কে সে তো আর ফেলে দিতে পারে না। অনেক কিছু ভালোও সে করেছে জীবনে চলার পথে। কেমন করে দূরে সরাবে এই এখানকার আমি কে? তাই থাক না। অসত্য মন্দে- ভালোয় একাই বয়ে নিয়ে বেড়াবে সে। শেষদিন অবধি। থাক না ‘আমি’ টা অধরা হয়েই। আজ সমস্ত নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব দূর করে এক অন্য ‘আমি’কে খুঁজতে চায় সে। এক পরিপূর্ণ আমি। যার এখনো অনেক কিছু ভালো করার অলিগলি ছড়িয়ে রয়েছে সামনে। সে পথেই সে এগোবে। নিঃস্বার্থভাবে। সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কিছু উপকারে আসা যদি একটুও স্বস্তি দেয় তাকে।

 

 



 

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল