ঘাসফুল

স্বাগতা ভদ্র
3.8 রেটিং
1978 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 9 , গড়ে : 3.8]

পাঠকদের পছন্দ

কোথায় জানি শুনেছিল শিউলি বাচ্চা হবার সময় মেয়েদের শরীরে অনেক ক’টা হাড় ভেঙে যায়। তারও ভেঙেছিল  হয়তো! প্রসব বেদনায় প্রাণ যাবার উপক্রম হয়েছিল তার, হাড় ভাঙাভাঙির কথা মনে আসবে এমন অবকাশ ছিলনা তখন। আজ  হঠাৎ কথাটা মাথায় এলো , ঠিক কয়ালবাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার সময়টায়। পেটের বাচ্চাটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়নি  শিউলি, শুধু আদরের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল একবার বুকভরে সন্তানের গন্ধটা শরীরে মেখে নেবার জন্য…. কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই শিউলির স্বামী আদিত্য ছোঁ মেরে বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিয়ে গর্জে উঠলো, “মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব , আমার বাচ্চার দিকে যদি হাত বাড়াস , শালী” । এই হাড়গুঁড়ো কথাটাই খানিক ভাবাল শিউলিকে। হাড়গুঁড়ো, প্রসব বেদনা, সন্তান, নাড়ীর টান, সম্পর্ক – এইসব শব্দগুলো  পাক খেয়ে উঠল শিউলির মাথার ভিতর আর টলোমলো পায়ে শিউলি পা রাখলো এক অচেনা পৃথিবীর নতুন ঘাসের শরীরে……

                                * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

তিনপুরুষ ধরে শক্তিপূজো করে আসছে কয়ালরা। এ বাড়ির পূজোর ভোগের প্রসাদ, চরণামৃতের মাহাত্ম্য জানেনা বর্ধমান শহরে এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। কুসুমগ্রাম আর ভালকির রাস্তা এসে ঠিক যেখানটায় জুড়েছে তার থেকে মাইল দুয়েকের মধ্যেই বর্ধমানের বিখ্যাত কয়ালবাড়ি । কয়ালদের পূর্বজরা ধান মাপার কাজ করতেন। শ্যামাচরণ কয়াল তার বুদ্ধির জোরে ও কঠোর  পরিশ্রমে নিজস্ব ধানগোলা তৈরী করেন সঙ্গে মাছের আড়তও। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি এ বংশের কাউকেই। আদিত্য ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল থেকে পাশ করে বেড়িয়ে, কমার্স নিয়ে পড়েছে কোলকাতার নামী কলেজে। বাবা তাকে এম. বি . এতেও ভর্তি করিয়েছিল কিন্তু পৈত্রিক ব্যবসায় বসে নবাবী করার যে সুখ, এম. বি.এ ক্লাসে সে সুখ নেই। তাই ফাইনাল পরীক্ষাটা তার আর দেওয়া হয়নি। ছোটো থেকেই ধান ঝাড়াই-এর গন্ধ, মাছের আঁশ গন্ধ, জনমজুরদের ঘেমো গন্ধ আর বাবার মুখের মদ – জর্দা মেশানো কড়া গন্ধের মধ্যে বড়ো হওয়া আদিত্য এম. বি.এ ক্লাসের বিদেশী সুগন্ধী মেখে আসা ছেলে মেয়েদের ভীড়ে হাঁফিয়ে উঠতো।বাবার পয়সা ছিল ঢের। মেয়েও কম ঘাটেনি সে! সল্টলেকের ফ্ল্যাটে বহু মেয়েরই অবাধ যাতায়াত ছিল একসময়। অনুরাধার সঙ্গে একটা স্টেডি রিলেশন থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার পা হড়কেছে তার। কিন্তু অনুরাধাকে  পাকাপাকিভাবে ছেড়ে দেবার পর থেকে মনে মনে একরকম সিদ্ধান্তই নিয়েছিল আদিত্য , এসব ঘাটাঘুটির মেয়েছেলেকে বিছানায় তুলতে পারে কিন্তু বৌ করবে না কক্ষনো। তার মতো অমন ইংরেজি বলিয়ে ছেলে বর্ধমান টাউনে ক’টাই বা আছে? তারওপর অমন বাড়ির ছেলে সে! মা গৌরীও ঠারেঠোরে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে অনেকবার। বলেছে, “বাবা আদি এ বাড়িতে মায়ের পোতিষ্টে করেছিলেন তোমার ঠাকুরদা মশাই, অনাছিষ্টি কান্ডি কক্ষোণো কোরোনি এই মায়ের থানে। মায়ের নিত্যি পূজো হয় বাম্ভোণ এনে। তোমার বাপ জ্যেঠারা রঙ্গ তামাশা হল্লা ফূর্তি যা করেন সবই ওই টাউনে। সেখানে তাদের আলাদা রোয়াব। সক্কলে জানে। কিন্তু সে সব পাপ তেঁনারা কিন্তু কক্ষনো এ বাড়িতে ঢোকাননি, বাবা। তোমাদের বাড়ির একটা ময্যিদে আছে । গোটা পাঁঠা এনে বলি হয় এথানে,খুঁত থাকলে পূজোয় বিগ্নি পড়ে, খুঁতো জিনিষের জায়গা এ বাড়ির সদরের বাইরে, অন্দরে নয়।” মায়ের কথায় মনে মনে  হাসে আদিত্য নারায়ণ। পাঁঠাইতো খুঁজছে সে,পাঁঠা নয়, পাঁঠা নয়-আস্ত রামছাগল, ধরবে আর এক কোঁপে….

                                  * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *    

বর্ধমানের ভালকি পঞ্চানন তলায় নয় নয় করে পঁচিশ তিরিশ বছরের বাস করুণার। রেলের চাকরি থেকে অবসর নেবার বছর পাঁচেক আগে এ বাড়ি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে ছিলেন করুণার শ্বশুরমশাই। বিয়ের পর থেকে  সেই শ্বশুরের বানানো বাড়িই করুণার পাকাপাকি ঠিকানা । তবে সে ঠিকানা তার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেই যেবার কয়াল বাড়িতেপূজো দিয়ে ছেলে দিবাকরকে চরণামৃত খাইয়েছিল করুণা, বছর ঘুরতে পারেনি,সেই সেইবারই ছেলে চাকরী পেয়ে গেল শিকাগোয়। যে সে চাকরী নয় একেববারে মোটা মাইনের চাকরী।  বাপমরা দিবাকর তখন আর কিছুতেই মাকে একলাটি ফেলে রাখতে চাইলো না বর্ধমানে। ঠিক করে ফেললো একবছরের মধ্যে মাকে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থাই সে করে ফেলবে। জন্ম থেকেই মামাবাড়িতে মানুষ বোনের মেয়ে শিউলি। মা , বাবা দু’জনেই ছিলো, তবুও। নৈহাটি স্টেশন থেকে নেমে সার সার দিয়ে যে একটানা কাঁসা পিতলের দোকান,সেখানেই কাজ করতো শিউলির বাবা অবিনাশ। বোন নমিতার সঙ্গে সেখান থেকেই প্রেম এবং বিয়ে। শ্যামনগর কালীবাড়িতে বিয়ে সেরে দু’জনে মিলে ভাড়া থাকতে শুরু করে চন্দননগর। কিন্তু কাজকর্ম সবইতো নৈহাটিতে –  মাস দুয়েক যেতে না যেতে পেটে বাচ্চাও এসে যাওয়ায় ফিরতেই হলো দু’জনকে। বোনের ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়ির শ্বশুরঘর মেনে নিতে পারলোনা শিউলির মামারা। তাই সবশুদ্ধু তুলে আনল নিজেদের বাড়িতে। সেই যে মাথাগোঁজার ঠাঁই পেল অবিনাশ, সে থেকে বাসা বদলাবার আর কোনো চেষ্টাই করেনি সে। ভায়েদের সংসার যত বেড়েছে ততই অপাংক্তেয় হয়েছে নমিতারা। দোতলা বাড়ির একটামাত্র ঘরে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে শিউলির মা। ভাইদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা সব সময় নীচুই থেকেছে তার, আর স্বামীর মেরুদন্ডহীনতায় বেড়েছে ঘৃণা। টেনে টেনে এগিয়ে চলা জীবনে দাদা-বৌদিদের মন জুগিয়ে রাখতে কোনো কাজে না বলেনি নমিতা, মনে মনে একটা লক্ষ্যেই স্থির থেকেছে সে, মেয়ে শিউলিকে মানুষ করা। তার প্রাপ্যটুকু হাতে তুলে দেবার জন্য বরের রোজগারের টাকায় ভরসা না করে পিকো করেছে, ফলস্ বসিয়েছে, ব্লাউজে হেম দিয়েছে। তবু কারো কাছে হাত পাতেনি করুণার আদরের বোন , শিউলির সর্বংসহা মা নমিতা।

তা সেই সেবার যখন পূজোর পর পরই দিবাকর মাকে বিদেশে নিয়ে যাবে স্থির হয়ে গিয়েছিল করুণাও  শিউলিকে একবার নিজের কাছে নিয়ে আসতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। আগে বহুবার তার এই ইচ্ছা ইচ্ছাই থেকে গেছে, মাকে ছেড়ে কখনও এক পা নড়েনি শিউলি।  নমিতাও চায়নি স্কুল কলেজ কামাই করুক মেয়েটা। কাঁকিনাড়া রাজকৃষ্ণ গার্লস থেকে পড়ে, ঋষি বঙ্কিম কলেজে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণির নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়া  সদ্য শুরু করেছে তখন শিউলি। বিদেশে যাবার আগে বোনের মেয়েটার একটা হিল্লে হয়ে যাক্ ভীষণ রকম চেয়েছিলেন করুণা। দিবাকরের মতো শিউলিকেও চরণামৃত খাওয়াতেই হবে তাকে। কত অসম্মান,কত অভিমান বুকে বেঁধে বোনটা তার জীবন কাটিয়ে দিল তা কি জানেন না করুণা? কিন্তু কী বা করার ছিল তার? স্বামী বেঁচে থাকাকালীন  বাপের বাড়ির কারোর সঙ্গেই সেভাবে যোগাযোগ রাখতে পারেনি করুণা, স্বামীই চাইতেন না। বিজয়া, ভাইফোঁটা, ওই ওটুকুই। তবে ওই যে বছরে দু চারবার, ওই যে দু’বোন মাদুরে পা ছড়িয়ে সারাদুপুর একবুক গল্প, ওই যে বর্ধমান লোকালে চেপে ফেরার সময় নৈহাটি স্টেশনে থমকে থাকা নমিতা আর শিউলির মুখ– ওটুকুই নমিতার কষ্ট পড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট ছিল করুণার কাছে। ফিরে এসেও সে মুখ এতটুকু স্বস্তি দেয়নি করুণাকে,বোনের প্রতি ভালোবাসা মনের কোণে বেদনা হয়ে বাড়তে থেকেছে রোজ রোজ। অন্যদিকে স্বামীর অমুলক , অনিয়ন্ত্রিত রাগও তাকে মেনে নিতে হয়েছিল নমিতারই মুখ চেয়ে।এক বোন যখন ভায়েদের ঘাড়ের ওপর অন্যজনের তখন সংসারে বিদ্রোহ করা সাজেনা, করুণা তা জানত। স্বামী মারা যাবার বছর খানেকের মধ্যে দিবাকরের চাকরী। স্বামী হরানো শোক তো ছিলই, কিন্তু এই প্রথম স্বাধীনতাকেও যেন ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিল করুণা। সেই স্বাধীনতার জোরেই তো বোন আর বোনের মেয়েকে জোর করে সেবার বর্ধমান নিয়ে আসা।ওদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো আকাঙ্ক্ষারা সেদিন গাড়ির ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে যেন দুলে দুলে উঠছিল। গাড়ির জালনায় মুখ রেখে তখন বাইরে তাকিয়েছিল শিউলি।নিষ্পাপ টলটলে চোখদুটোয় কত্ত স্বপ্নের আনাগোনা, সবটাই যেন পড়ে ফেলেছিল করুণা আর নিজের অজন্তেই  কপালে জোর হাত উঠে গেছিল তার, চোখের জলের সঙ্গে একটাই কামনা উঠে এসেছিল স্নেহার্দ্র হৃদয় থেকে “মঙ্গল করো মা, মঙ্গল হোক্”।

                               * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

দরজার বাইরে পা রাখতেই কয়াল বাড়িতে প্রথম আসার দিনটা মনে পড়ে গেল শিউলির। কালীপূজোর রাতে মা , মাসীর সঙ্গে এই দরদালানেই এসে দাঁড়িয়েছিল সে। ঢাকের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ, যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ-সবটা, সবটা আজও চোখে ভাসে শিউলির। একমহিলা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন, আর ভীড়ের মধ্যে থেকে কারা যেন “জয় মা,জয় মা” বলে চিৎকার করে উঠছিল তাদর চারপাশে। কেমন একটা ভয় ভয় করছিল শিউলির। আর  সেই ভয়টাই আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল ঠিক পাঁঠাবলির মুহূর্তটায়।চেয়ে দেখতে পারেনি শিউলি, চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে। ঠিক সে সময়ই তার চোখে চোখ পড়েছিল এ বাড়ির ছেলের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে এসেও ওই অসহায়ের ছট্ ফটানি ভুলতে পারেনি সে। বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়রির পাতায় হঠাৎই লিখেছিল

  “কত লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে সাধের পেয়েছি এ মানব জনম………”

আজ , আজও মনে এলো সেই একই গান। ছোট্ট শিশুর দুধের গন্ধমাখা শরীরটা নুড়িপথের ওপর টানতে টানতে চিৎকারে ফেটে পড়ে বলতে চাইল শিউলি এ মানব জনম কিছুতেই ছেড়ে দেবেনা সে।          

                         * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

জীবন-যুদ্ধে হেরে যেতে যেতেও শুধু শিউলি হতে চেয়েছিল সে। শুধু মানবীই তো হতে চায় শিউলিরা।            

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল