দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা

প্রোজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায়
5 রেটিং
1385 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

‘The fact is, both sides killed. Both shot, stabbed, speared, clubbed. Both tortured, both raped.” —-     খুশবন্ত সিং
            উপরোক্ত মন্তব্যটি পাঠকের মনে ভয় ও বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সত্যিই তো, স্বাধীনতা দিবসের সকালে কেই বা চায় খুন রাহাজানি ধর্ষনের মত নারকীয় ঘটনার কথা শুনতে? আসলে সমস্যাটি অন্য জায়গায়। যে পবিত্র দিনটি আমরা স্মরণ করতে চলেছি, সেই দিনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত উপরের মন্তব্যটি। বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রেই নিশ্চয়ই বুঝেছেন খুশবন্ত কিসের কথা বলেছেন। হ্যাঁ, দেশভাগ। যে রক্তক্ষয়ী মর্মান্তিক ঘটনার বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতা দিবসে আজ সবাই যখন পতাকা উত্তোলন এবং মিষ্টি বিতরণে ব্যস্ত, একবার ঘুরে আসা যাক সেই রক্তাক্ত দিনগুলির আনাচে কানাচে।
           স্বাধীনতা লাভের ঠিক প্রাক্কালে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল, তা ভারী চমৎকার ভাবে বুঝিয়েছেন সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, একবার দেখে নেওয়া যাক সেই সত্যসন্ধান,
 ” আমাদের পাটনা যাত্রার পর হইতে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত এই কয়মাস আমাদের জীবনের ধারাবাহিকতা অনেকটা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।—– শুধু যে আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ হইতেছিল তাহা নয়, সারা ভারতবর্ষের জীবনে এক মহা সন্ধিক্ষণ দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিতেছিল। স্বাধীনতা আসিতেছে, রক্তাক্ত দেহে বিক্ষত চরণে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা ভেদ করিয়া আসিতেছে। স্বাধীনতা যখন আসিবে হয়তো মুমূর্ষু রক্তহীন দেহে আসিয়া উপস্থিত হইবে। তাহাকে বাঁচাইয়া তুলিতে প্রত্যেক ভারতবাসীকে হৃদয়রক্ত নিংড়াইয়া দিতে হইবে। তবু স্বাধীনতা আসিতেছে ; স্বার্থ-নিষ্ঠুর বিদেশী শাসকের খড়্গে দ্বিখণ্ডিত হইয়াও হয়তো বাঁচিয়া থাকিবে। আশা আশঙ্কায় কম্পমান সেই দিনগুলির কথা স্মরণ হইলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।         একদিন বৈকালে ময়দানে বেড়াইতে বেড়াইতে কৈশোরের এক বন্ধুর সাথে দেখা হইয়া গেল। পরিধানে শেরওয়ানী পায়জামা সত্ত্বেও চিনিতে পারিলাম— স্কুলে যাহার সহিত প্রাণের বন্ধুত্ব ছিল সেই ফজলুর রহমান। দুজনে প্রায় একসঙ্গেই পরস্পরকে চিনিতে পারিলাম এবং সবেগে আলিঙ্গনাবদ্ধ হইলাম।  ‘ ফজলু !’ ‘ অজিত !’ কিছুক্ষণ পর বাহুবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমি দুই পা পিছাইয়া আসিলাম, ফজলুর দিকে গলা বাড়াইয়া দিয়া বলিলাম, ‘ নে ফজলু, ছুরি বার কর। এই গলা বাড়িয়ে রয়েছি।’ ফজলু নিজের হাতের মোটা লাঠিটা আমার হাতে ধরাইয়া দিয়া বলিল, ‘ এই নে লাঠি, বসিয়ে দে আমার মাথায়। তোদের অসাধ্য কাজ নেই।’ তারপর আমরা ঘাসের উপর বসিলাম, ব্যোমকেশের সহিত ফজলুর পরিচয় করাইয়া দিলাম। ফজলু এখন পাটনা হাইকোর্টে ওকালতি করিতেছে। প্রচণ্ড পাকিস্তানী। সুতরাং তুমুল তর্ক বাঁধিয়া গেল। কেহই কাহাকেও রেয়াৎ করিলাম না। শেষে ফজলু বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, অজিতের সাথে তর্ক করা বৃথা, ওর ঘটে কিচ্ছু নেই। কিন্তু আপনি তো বুদ্ধিজীবী মানুষ, আপনি বলুন দেখি দোষ কার— হিন্দুর, না মুসলমানের ?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘ এক ভস্ম আর ছার, দোষ গুণ কব কার।’ —-


 উন্মত্ত হিংসার পিশাচ-নৃত্য আবার শুরু হইয়া গেল। প্রথমে নোয়াখালি, তারপর বিহার।— ফজলু এই হিংসা-যজ্ঞে প্রাণ দিল। সে সত্যনিষ্ঠ সাহসী পুরুষ ছিল, যাহা বিশ্বাস করিত তাহা গলা ছাড়িয়া প্রচার করিত; তাই বোধ হয় তাহাকে প্রাণ দিতে হইল। ” —- (আদিম রিপু)
নিজের বিখ্যাত ব্যোমকেশ কাহিনী ‘আদিম রিপু’র মাধ্যমে শরদিন্দু অত্যন্ত দক্ষ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন দেশভাগের সময়কার পরিস্থিতি। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এই চিত্র আমাদের সামনে উপস্থিত করে দুটি সারসত্য। প্রথমত, স্বাধীনতার সময়কালে মানুষের জীবনের দাম আচমকাই কমে কানাকড়িও ছিল না। দ্বিতীয়ত, আজ যতই তেরঙ্গা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হোক না কেন, স্বাধীনতার সময়ে দেশীয় আবেগের থেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল ধর্মীয় আবেগ। 

          ১৯৪০ সালে সুবিখ্যাত লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লিগ পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করে, যে প্রস্তাবের মাধ্যমে মহম্মদ আলি জিন্না দাবি করেন যে, ভারতে হিন্দু এবং মুসলিম কেবলমাত্র দুটি ধর্ম সম্প্রদায় নয়, তারা দুটি পৃথক জাতি। তাই তাদের একসাথে থাকা মানে ভবিষ্যতের অশান্তির বীজ প্রোথিত অবস্থায় থেকে যাওয়া।  সমাধান হিসেবে তাঁরা চান পৃথক দেশ, যার নাম হবে পাকিস্তান। মজার বিষয় হল যে, এর বেশ কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ড প্রবাসী ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি যখন প্রথম এই দাবি পেশ করেছিলেন, তখন মুসলিম লিগ নেতৃত্ব এই প্রস্তাবকে ‘ ছাত্রের দিবাস্বপ্ন ‘ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪০ পরবর্তী সময়ে রকেটের গতিতে এগোতে থাকে ঘটনাপ্রবাহ। জাতীয় কংগ্রেস প্রথমে এই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিলেও, আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যায় মহাত্মা গান্ধীর মত কতিপয় মানুষ বাদে সকলেই দেশভাগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। একমাত্র গান্ধী নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি, স্বাধীনতা লাভের শেষ পর্যায়ে তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষ কংগ্রেসী রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নেন। আরও আশ্চর্যজনক ভাবে ব্রিটিশ সরকার স্যার সিরিল রাডক্লিফকে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব দেন যিনি এর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পা রাখেননি, এবং ভারতীয় জীবনযাত্রা, আচার আচরণ সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়।

রাডক্লিফকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই, অর্থাৎ মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দেওয়া হয় তাঁকে। আক্ষেপের বিষয় এটাই যে, এমন একটি তুঘলকি কাণ্ড নিয়েও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের তরফে তেমন প্রতিবাদ আসেইনি। ফলস্বরূপ ভারত সম্পর্কে ধারণা না থাকা এক মানুষের মাত্র পাঁচ সপ্তাহের পড়াশোনার উপর ভিত্তি করে করা মানচিত্রের অস্ত্রোপচারের দরুন ২০০০ বছরের সভ্যতা হয়ে গেল দুই টুকরো।
         উপরে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে না কি পরিমান ঝড় বইয়ে দিয়েছিল সিরিল রাডক্লিফের পেন্সিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতারাতি ঘর বাড়ি খুইয়ে, এতদিনের সাজানো সংসার ফেলে চলে যেতে বাধ্য হন অজানা জায়গায়। পৃথিবীর বুকে ঘটে যায় সর্বকালের বৃহত্তম মাইগ্রেশন। হাজার হাজার মানুষ পরিণত হন উদ্বাস্তু শিবিরের বাসিন্দায়। কিন্তু শুধু কি এই? না, এ হল শুধুই পটভূমি। নারকীয় কাণ্ডের অকুস্থলে পরিণত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ। বাংলা ও পাঞ্জাবের মত যেসব জায়গার ওপর দিয়ে রাডক্লিফের পেন্সিল নামক ছুরি চালিত হয়, পরিণত হয় রক্ত উপত্যকায়। যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগ সাধিত হয়, হিন্দু এবং মুসলিম, যারা একে অপরের প্রতিবেশী, সুখ দুঃখের সাথী হিসেবে বছরের পর বছর থেকে এসেছেন, আচমকাই একে অপরের শত্রুতে পরিণত হন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাঁর ‘ Identity and Violence: Illusions of Destiny’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন কিভাবে এতদিনের সুখদুঃখের সাথীরা নিজেদের বাঙালি পরিচয় খুইয়ে হয়ে উঠেছিলেন শুধুমাত্রই হিন্দু এবং মুসলিম। অধ্যাপক সেন চল্লিশের দশকের একটি ঘটনার কথা এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যখন তিনি ছিলেন নেহাতই এক বালক। বহুদিনের পরিচিত এক মুসলিম রাজমিস্ত্রি ছুরিকাহত অবস্থায় তাঁদের বাড়িতে দৌড়ে এসে একটু জল চান। তাঁর পরিবার সঙ্গে সঙ্গেই ওই আহত লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। বালক অমর্ত্য ভীষণ প্রভাবিত হন এই ঘটনায়। তিনি লিখেছেন, ” For a bewildered child, the violence of identity was extraordinarily hard to grasp.” তাঁর কাছে গোটা বিষয়টিই ছিল ‘veritable nightmare’। শুধু অমর্ত্য সেন নন, তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রতিটা ইঞ্চিতে দেশবিভাগের যন্ত্রণা এতই তীব্র আকার ধারণ করে যে ম্লান হয়ে যায় আসন্ন স্বাধীনতা লাভের আনন্দ। শুধু তো হিন্দু অথবা মুসলিম সম্প্রদায় নয়, শিখ সহ অন্যরাও জড়িয়ে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী নরমেধ যজ্ঞে। সাদাত হাসান মান্টো তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ ঠান্ডা গোস্ত ‘ এ দেখিয়েছেন এক উন্মত্ত শিখ যুবার এক মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়ে আবিষ্কার করা যে সেটি কেবলই এক ঠান্ডা খুন হয়ে যাওয়া মৃতদেহ মাত্র।এই ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরে সেই সময়ের রক্তাক্ত ধর্ষিত সমাজ রাজনীতির ছবি।

শরণার্থী বোঝাই ট্রেন বাসে হামলা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষে ভর্তি লাহোর গামী এক ট্রেনে শিখ দাঙ্গাবাজদের হামলা এবং ট্রেনের প্রতিটি মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার কুখ্যাত ঘটনা নিয়ে খুশবন্ত সিং তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘A Train to Pakistan’ রচনা করেছিলেন। ঘটনাচক্রে, ট্রেনটি যখন লাহোর স্টেশনে প্রবেশ করে, উপস্থিত জনগণ আর্তনাদ করে ওঠেন এক ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ আবিষ্কার করে। ট্রেনটির ইঞ্জিনে লেখা ছিল ‘a gift to Pakistan’। দেশভাগ পর্বের সবথেকে ভয়ঙ্কর চিত্র হিসেবে এই দৃশ্যটি পরিগণিত হয়। আবার, লাহোর বাসী পার্সি সাহিত্যিক বাপসি সিধওয়া তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘Ice Candy Man’ এ দেখিয়েছেন সংখ্যাগুরু ধর্ম সম্প্রদায়গুলোর মাঝে পার্সি, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের বিভ্রান্তি। যদিও ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগ হয়, এই মানুষগুলোর কথা নেহরু, জিন্না, মাউন্টব্যাটেন কেউই ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। ফলস্বরূপ এঁরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন কি হতে চলেছে বুঝতে না পেরে। সিধওয়া তাঁর উপন্যাসে এক হিন্দু মহিলার দুরবস্থা ও বর্ণনা করেন, যে তার মুসলিম প্রেমিককে ছাড়তে না চাওয়ার জন্য লাহোরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অপহৃতা এবং ধর্ষিতা হয়। এসব টুকরো টুকরো সাহিত্যের অংশবিশেষ সফলভাবে তুলে ধরে তৎকালীন করুণ পরিস্থিতি। যদিও রাডক্লিফের কাঁচি চালনার আগেই ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট খাস কলকাতা শহরেই প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে ঘটে যায় the Calcutta killing, যেদিন কলকাতা শহরের

রাজপথে, অলিতে গলিতে খুন ধর্ষনের শতাধিক ঘটনা ঘটে। ১৯৪৬ সালের লক্ষ্মীপূজার দিন থেকে শুরু হয় কুখ্যাত নোয়াখালী দাঙ্গা। মুসলিম লিগ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে পূর্ব বাংলার নোয়াখালিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। এমনকি সম্ভ্রান্ত, ধনী হিন্দু পরিবারগুলি তেও হামলা চালানো হয়। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গান্ধীজি ছুটে যান ঘটনাস্থলে, তাঁর সাথে যান কংগ্রেস নেত্রী সুচেতা কৃপালনী (যিনি পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল পদ লাভ করেছিলেন)। শোনা যায়, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, সুচেতা পটাসিয়াম সায়নাইড সহ ওই এলাকায় প্রবেশ করেন এবং ঘোষণা করেন যে, কেউ তাঁকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলেই তিনি আত্মহত্যা করবেন। গান্ধীজি দীর্ঘদিন ওই এলাকায় পড়ে থাকলেও ক্ষমতার লোভে মত্ত কংগ্রেসের তৎকালীন নামীদামী নেতারা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ১৯৪৭ সালের জুলাই আগস্ট মাসে উদ্বাস্তুর স্রোতে পরিস্থিতি ভারত সরকারের নাগালের বাইরে চলে যায়। শোনা যায়, চারিদিক থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ পেতে পেতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্বগতোক্তি করেছিলেন ‘ এ আমরা কি ভুল করলাম! ‘ যদিও পরিস্থিতি ততদিনে আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। বলা যেতে পারে মানুষের মৃতদেহ পদদলিত করেই হাজির হয় স্বাধীনতা। ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ রাত ১২ টায় স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহরু যখন সংসদে সেই অমর ঘোষণাটি করছেন যে, ” at the stroke of the midnight hours, when the whole world sleeps, India will awake to life and freedom”, তখনই বাংলা ও পাঞ্জাবের একাধিক জায়গায় চলছে নরমেধ যজ্ঞ।                   

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল সহ অনেকেই মনে করেন, দেশভাগের ক্ষত যে সেই সময়েই শুকিয়ে গিয়েছিল এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। বস্তুত, এই ঘটনার রেশ কাটতে ভারতীয় উপমহাদেশের পাঁচশো বছর লেগে গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এর আভাস পাওয়া গিয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের তাড়াহুড়োর ফলে বহু এলাকার মানুষ অন্ধকারেই ছিলেন তাঁরা কোন দেশের অংশ হলেন। খুলনায় (যা বর্তমান বাংলাদেশের অঙ্গ) ভারতের পতাকা উত্তোলন হয় আবার বর্তমান মুর্শিদাবাদ ও দার্জিলিঙে (বর্তমানে ভারতের অঙ্গ) পাক পতাকা উত্তোলিত হতে দেখা যায়। এও দেখা যায় কারোর বাড়ির মাঝবরাবর চলে গেছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ‘ রাজকাহিনী ‘ ছবিতে এরকম এক কাল্পনিক ঘটনার চিত্রায়ণ দেখা গেছে। এসব ঘটনা খুবই আশ্চর্যের মনে হলেও যখন মনে করা যায় যে এই পুরো প্রক্রিয়াটি রাডক্লিফ সম্পন্ন করেছিলেন মাত্র পাঁচ সপ্তাহে, তখন আর বিস্ময় জাগে না। দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দেয়, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ কাশ্মীর সমস্যা। দেশভাগের বিভ্রান্তির সমস্যা যে এখনও বিদ্যমান, কাশ্মীর তার সবথেকে বড় উদাহরণ। দ্বিজাতি তত্ত্ব যে সর্বত্র ঠিক ছিল না, তার প্রমাণ ১৯৭১ সাল। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য যে পৃথক দেশ সৃষ্ট হয়, সেই পাকিস্তানেরই পূর্ব অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম দেয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে জিন্না যুক্তি দেখিয়েছিলেন পৃথক রাষ্ট্রেই মুসলিমদের নিরাপত্তা এবং শান্তি সুনিশ্চিত। সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নতুন রাষ্ট্রের জন্ম যেন সেই দ্বিজাতি তত্ত্ব কেই বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করে। বহু পরিবার কেও বিভক্ত করে দিয়েছে কাঁটাতার। সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষের ‘The Shadow Lines’ উপন্যাসে একটি পরিবারের কথা বর্ণিত আছে যেখানে দেশভাগের পরেও পূর্ববঙ্গের ঢাকায় এক হিন্দু পরিবারের এক বয়স্ক সদস্য পৈতৃক বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একাই পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।  পরবর্তীকালে ঢাকা শহর যখন মুসলিম শরণার্থীদের স্রোতে ভরে যায় এবং নিজের সম্পত্তি বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, তিনি এক মুসলিম পরিবারকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে তাদের সাথেই বসবাস করতে থাকেন, এবং সম্প্রীতির পরিচয় দিয়ে সেই মুসলিম পরিবারটিও বয়স্ক মানুষটিকে দাদুর সম্মান দিয়ে আপন পরিবারের মতই যত্ন করতে থাকে। বাস্তবক্ষেত্রেও আমরা দেখি প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের দিল্লি সফরে তাঁর জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা বা প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পাকিস্তানে নিজের জন্মভিটেতে একবার হলেও পদার্পণ করার ইচ্ছা। তাঁদের মত ক্ষমতাশালী মানুষের এই ইচ্ছা পূরণ হলেও অগণিত সাধারণ মানুষের এই ইচ্ছা বেশিরভাগ সময়েই পূর্ণ হবার নয় কারণ দুই দেশের তিক্ত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে ভিসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘ শঙ্খচিল ‘ ছবিতে এক সেনা অফিসারের চরিত্র পরিবেশিত হয়েছে, যে সংশয় প্রকাশ করে হাজার হাজার বছর ধরে যে পথে অবাধে মানুষ চলাচল করেছে, সেখানে আচমকা কাঁটাতার বসিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত! যাবতীয় অবৈধ পারাপার সহ অনেককিছুই নিজেদের শিকড় আবিষ্কার করতে পারে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, যেদিন আচমকা বহুদিনের সহাবস্থানের মাঝে উঠে গিয়েছিল বিভেদের কাঁটাতার। 
           প্রখ্যাত পাকিস্তানি চিন্তাবিদ আয়েশা জালালের মতে, দেশভাগের ফলে নবগঠিত দুই দেশ সমপরিমাণ সমস্যার মুখোমুখি হলেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনড় থেকে এবং উদারনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারণে ভারত অনেক ভালোভাবে সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। একাধিক সেনা অভ্যুত্থান, মৌলবাদী চিন্তার আঁতুড়ঘর পাকিস্তান যা করতে সফল হয়নি। তাই যমজ দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ভারত কাঁটাতারের ঘা মোটামুটি সারিয়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু সত্যিই কি পেরেছে? ভারত নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র হিসেবে অনেক বেশি সফল। কিন্তু আজও কি পশ্চিমবঙ্গের কোন অখ্যাত গ্রামের বাড়িতে বসে অশীতিপর কোন বৃদ্ধা চোখের জল ফেলেন না ছেলেবেলার পদ্মার তীরে খেলার স্মৃতি মনে করে? পাঞ্জাবের ধাবার খাটিয়ায় বসে পাগড়ি পরিহিত শিখ যুবা কি কখনো উদাস হয়ে যান না দাদির মুখে শোনা লাহোরের পৈতৃক বাড়ির কথা ভেবে? অমিতাভ ঘোষ তাঁর ‘The Shadow Lines’ উপন্যাসে এক বৃদ্ধার কথা লিখেছিলেন, যিনি আকাশপথে বাংলাদেশে পৈতৃক বাড়ি ঘুরতে যাওয়ার সময় নিচে তাকিয়ে সেই রেখাটিকে খুঁজছিলেন, যে রেখা তাঁর জীবনটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। না, নীচের জমিতে কোন রেখা তিনি পাননি, কারণ প্রকৃতির কোন সীমারেখা হয় না, মাতৃভূমির কোন বিভেদ রেখা হয় না, রেখার অস্তিত্ব থাকে কেবল সিরিল রাডক্লিফ, লর্ড মাউন্টব্যাটেনদের সৃষ্টি করা মানচিত্রে। মা কি কখনও ভাগের হতে পারে? উত্তর একটাই, না পারে না। উত্তরটি সম্যক বুঝেছিলেন সাদাত হাসান মান্টো, যখন তিনি তাঁর শক্তিশালী লেখনীতে ব্যঙ্গ করেছিলেন দেশভাগের কুশীলবদের, “Hindustan had become free. Pakistan had become independent soon after its inception but man was still slave in both these countries– slave of prejudice…slave of religious fanaticism..slave of barbarity and inhumanity.”


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-১। আদিম রিপু। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স।২। Identity and Violence: Illusions of Destiny. অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। পেঙ্গুইন বুক ইন্ডিয়া।৩। A Train to Pakistan. খুশবন্ত সিং। পেঙ্গুইন বুক ইন্ডিয়া।৪। A collection of short stories. সাদাত হাসান মান্টো। রাজকমল প্রকাশন।৫। Ice Candy Man. বাপসি সিধওয়া। পেঙ্গুইন বুক ইন্ডিয়া।৬। The Shadow Lines. অমিতাভ ঘোষ। অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া।৭। The Dawn সংবাদপত্র। করাচি, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত। অনলাইন সংস্করণ।৮। The Guardian সংবাদপত্র। লন্ডন, ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত। অনলাইন সংস্করণ। ৯। পূর্ব পশ্চিম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স। 

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল