বিতর্কিত নাকি ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রনাথ?

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
0 রেটিং
1301 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

চীনে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবদ্দশায় বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তিনি বক্তৃতা করেছেন, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করেছেন। আবার ফিরে এসে লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী। তবে চীনের ভ্রমণ ছিলো ব্যতিক্রমী। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৮১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চীনে মরণের ব্যবসা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি চীনের জনগণের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং চীনে ব্রিটিশদের আফিমের ব্যবসাকে ডাকাতি বলে উল্লেখ করেন। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিন বছর পর ১৯১৬ সালে জাপান ভ্রমণ করেন এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ভারত থেকে সমুদ্রপথে জাপান যাবার সময় হংকংয়ে যাত্রা বিরতি হয়। সেখানে কিছু চীনা শ্রমিকের দেখা পান রবীন্দ্রনাথ। চীনা শ্রমিকের কাজ করার শৃঙ্খলা ও উদ্যম দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন,“কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা সমস্ত দেশজুড়ে সঞ্চিত হচ্ছে। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করছে, কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিততে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়”।

চীনের এই ভেতরে সঞ্চিত অসীম সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে পেরে সেসময়েই আগাম ধারণা করতে পেরেছিলেন তিনি; যা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,“এই এত বড়ো একটা শক্তি যখন আধুনিক কালের বাহনকে পাবে, অর্থাৎ যখন বিজ্ঞান তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগ সাধন হবে”।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে চীনাদের ধারণা ছিলো উচ্চমার্গীয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর তার নাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে চীনা তরুণেরা তার সম্পর্কে ছিলো ব্যাপক আগ্রহী। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলায় সাহিত্য রচনা করতেন। তারপর সেটা অনুবাদ হতো ইংরেজিতে। ইংরেজিতে অনুবাদ হলে ইংরেজি থেকে সেটা অনুবাদ হতো চীনা ভাষায়। চীনের সকলের কাছে যে রবীন্দ্রনাথ পূজনীয় ছিলেন এমনটি নয়। ২০২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পা রাখবে। ঠিক শতবর্ষ আগে চীনের অবস্থা এখনকার মতো উন্নত এবং সভ্য ছিলো না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে চীন কেবল আফিমের নেশা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। চীন বুঝতে শুরু করেছে পশ্চিমা দাসত্ব কখনো মুক্তি দেবে না। তৎকালীন চীনা তরুণরা জ্ঞানের অনুসন্ধান এবং চর্চা করতে শুরু করেছে। সমন্বয় স্থাপন করেছে জ্ঞানস্পৃহা ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে। ভাববাদের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে তারা তখন বস্তুবাদের ওপর ভর করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর, যারা দেশের মানুষের বঞ্চনার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তারা পড়তে শুরু করেছে, লিখছে, যেকোনো বক্তব্য পেলে চলছে সে বক্তব্যের অতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চলছে যাচাই এবং পরিশেষে গ্রহণ অথবা সরাসরি বর্জন। তরুণরা ১৯২১ সালে গড়ে তুলেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। চারিদিকে তখন প্রবল উত্তেজনা; প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চলছে বিপ্লবের প্রস্তুতি। এমনই এক বিপ্লবের প্রস্তুতিকালে ১৯২৪ সালের ১২ই এপ্রিল চীন ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। ৪৯ দিনের এই ভ্রমণের প্রথম সপ্তাহের এক বক্তৃতার সারমর্ম ছিলো,“ভাববাদকে ফিরিয়ে আনতে হবে, সে কারণে ধ্বংস করতে হবে বস্তুবাদকে।”

শুরুতেই এমন বক্তব্য দেয়ার পর অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। চীন ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথকে বেশ নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত বাংলা ভাষার কবি, কিন্তু ভাষাগত বিশাল পার্থক্যের কারণে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠেনি। সমগ্র ভ্রমণে তিনি একবারের বেশি সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাননি, তাই বার বার ফিরে যেতে হয়েছে মতাদর্শে। রবীন্দ্রনাথ শুধু যে ভাববাদের পক্ষে বলেছেন তা নয়, অনেক বক্তব্যে ভাববাদের বিরোধিতা করেছেন বটে, তবে একইসাথে বস্তুবাদেরও বিরোধিতা করেছেন। উপস্থিত তরুণদের মধ্যে সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন মাও সে তুং। তারা তখন উঠতি বিপ্লবী। শ্রেণিসংগ্রামের প্রতি প্রবল বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ সেই বিশ্বাস ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। তরুণ বিপ্লবীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এটা আয়োজকদের ষড়যন্ত্র আর তাদের হয়ে দালালী করছেন রবীন্দ্রনাথ! পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিরুদ্ধে লেখালেখি হয়েছে, সব লেখা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। তিনি পড়েছেন, প্রতিক্রিয়া হিসেবে বক্তব্য প্রদান অনুষ্ঠান স্থগিত করেছেন। এমনকি বক্তৃতা করার সময় প্রবল বিক্ষোভের মুখে বক্তৃতা দানে ইস্তফা প্রদানও করতে হয়েছিলো। চীন ভ্রমণের পূর্বে অন্য কোথাও রবীন্দ্রনাথ বিড়ম্বনায় পড়েননি এমন নয়। জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেও তাকে পড়তে হয়েছিলো ঝামেলায়। সেখানে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছিলেন পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদের।

জাপানে কবিগুরু

জাপানিরাও কবিকে ছেড়ে কথা বলেনি। পত্রিকায় লিখেছে, “রবীন্দ্রনাথ পরাজিত ও শৃঙ্খলিত জাতির কণ্ঠস্বর; তাঁকে গুরুত্ব না দিলেও চলবে”। আমেরিকানরা বলেছে, “রবীন্দ্রনাথের বাণী অসুস্থ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন, তিনি মহৎ আমেরিকার যুব সমাজের মনে বিষ ছড়াবার তালে আছেন, তাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন”। তবে চীন ভ্রমণ ছাপিয়ে গেছে অন্য সব বিড়ম্বনাকে। বিরোধটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিলোনা, ছিলো তার মতাদর্শের প্রতি। বক্তব্য চলাকালীন তাকে শুনতে হয়েছে, “পরাধীন দেশের চাকর ফিরে যাও।আমরা দর্শন চাই না। চাই বস্তুবাদ”।

এতকিছুর পরও রবীন্দ্রনাথের বাণী বিফলে যায়নি। ১৯১৬ সালে তিনি চীন সম্পর্কে আগাম বার্তা প্রদান করেছিলেন। বলেছিলেন বিজ্ঞানের সাহায্য যখন চীনাদের কর্মক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হবে তখন অসাধ্যকে সাধ্য করতে পারবে তারা। ঠিক তার কিছু বছর পর চীনে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিলো। চীন এগিয়ে গিয়েছিলো মুক্তির পথে। ১৮৭২ সাল থেকে অর্থনীতিতে বিশ্বে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় দেড়’শ বছর পর তাদের হটিয়ে ২০১৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষস্থান দখল করে চীন। সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ প্রশ্নের উত্তরও তারা দিচ্ছে সমান তালে।কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক ও হয়ে উঠছে নাকি একই সাথে?

ভ্রমণকাহিনী লেখায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ি নেই, তবুও চীন ভ্রমণ সম্পর্কে তেমন কিছুই লিখেননি বিশ্বকবি। বিরক্তিই ছিলো এর প্রধান কারণ। একারণে রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণ ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি। চৈনিক তান ওয়েন তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন, বাঙালি শিশিরকুমার দাশ তার সাহায্য নিয়ে লিখেছেন ‘বিতর্কিত অতিথি: রবীন্দ্রনাথ ও চীন’।

©️শঙ্খচিল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

  • Anonymous May 18, 2020 at 1:00 pm

    পড়ে খুব ভালো লাগলো। জানা ছিল না।

  • ABTTC Alumni May 18, 2020 at 1:08 pm

    অসাধারণ

  • নতুন প্রকাশিত

    হোম
    শ্রেণী
    লিখুন
    প্রোফাইল