বিসর্জন

অর্পণ (শঙ্খচিল) ভট্টাচার্য্য
5 রেটিং
914 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ

মহালয়ার ভোর , আর পাঁচটা দিনের মতোই সাধারণ নিয়নের কাছে। মাসি বেল বাজাতেই তিথির কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দৌড়ে বের হয়ে গেল ও। তিথির সকাল থেকেই মন ভাল নেই। আজকের দিনেও নিয়ন কাজে বের হোক, চায়নি তিথি। এই জায়গাটায় কিছু করতে পারে না নিয়ন । চাকরি-ই একমাত্র যা ওর সমস্ত মন খারাপ ভুলিয়ে রাখতে পারে হাজার ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে । তবে তিথির জন্য কখনো আক্ষেপের জায়গা রাখেনি নিয়ন গত এগারো বছরে।

গত বারো- তেরো বছরের মায়ের সব অভাবটাই প্রায় মিটিয়ে এসেছে মাসি, কখনও ভাবেইনি বাড়িতে কাজ করতে এসে এতোটা প্রয়োজনীয় ও কাছের হয়ে উঠবেন মাসি আর তার মেয়ে তিন্নি। আজ মাসি কেই মা বলে ডাকে নিয়ন, আর তিন্নিকে বোন।

দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো নিয়ন, আজ মাসির ফিরতে দেরি হয়ে যাবে না তো!

কলিং বেল,

মাসি দরজা খুলতেই তিনটে কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঢুকে পড়লো নিয়ন, “সরি মা,একটু দেরি হয়ে গেল।”

মাসি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটো ব্যাগ মাসির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “এতে তোমার আর বোনের কাপড় আছে, কোন সমস্যা হলে আমায় জানিও, বদলে আনব।”

মাসি হেসে মাথা নেড়ে বেরিয়ে যান, আর টেবিলে খাবার রাখা আছে দেখিয়ে দেন নিয়নকে।

আজ অষ্টমী, মাসি নতুন শাড়িটা পড়িয়েছেন তিথিকে, বোনও এসেছে নতুন কাপড় পড়ে। আজ প্রায় এগারো বছর মণ্ডপে অঞ্জলি দেয়নি তিথি, আজও পারবে না। এখন আর মন খারাপ হয়না এই নিয়ে। মাসি নিয়নের খেয়াল রাখছে অনেক আগে থেকেই, যখন নিয়ন প্রথম চাকরি পেল। ভাড়া ঘর, মা হারা ছেলে, বাবাও যোগাযোগ রাখেনি।

তারপর একদিন তিথি কে নিয়ে এল বাড়িতে, মাসির সাথে আলাপ হল সেদিনই।

এরপর যেদিন এল বাড়িতে, মাসি বরণ করলেন লাল সিঁথি ভরা তিথিকে।

তারপর, নিয়ন শেষবার এল তিথিকে নিয়ে, স্ট্রেচারে।

বিয়ের পর প্রথম পুজো, রাতের বাইক রাইড এবং অ্যাক্সিডেন্ট, তিন বছর কোমা ।

এখন শুধু চোখটা কথা বলে তিথির, ঠিক প্রথম দিন যেমন বলেছিল নিয়নের সাথে। ঘোর লেগে গিয়েছিল নিয়নের, আজও লাগে। যখন ঠিক সামান্য কোন কারণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তিথি, গুমরে ওঠে, সে শব্দ সবাই শুনতে পারে না। বোন পারে না, নিয়নের কলিগরা পারে না, ডাক্তার পারেননি, নার্সরা পারেনি, শুধু মাসি পেরেছিল, আর নিয়ন নিজে। নিয়ন রাতের পর রাত কাটিয়েছিল তিথির সামনে আধখোলা চোখে। সবাই ভেবেছিল তিথি বাঁচবে না, তবুও যে আজও আছে, তার কৃতিত্ব মাসির ও খানিকটা নিয়নের ।

কখনও কেউ চায়নি তিথি আর নিয়নের গল্প টা এভাবে শেষ হয়ে আসুক, হাজারটা স্বপ্ন সাজিয়ে রাখা তিথি আজ কোনভাবেই সেই পথ চলা গুলোকে সত্যি করতে পারে না, শুধু ছটফট করে ভেতর ভেতর, দুজনেই।

আজ দশমী।বাইরে সকাল থেকে মন কেমনের ঢাক বাজছে। তিথি অসাড় ভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে, আর পাঁচটা দিনের মত।

কিন্তু আজকের দিনটা আর পাঁচটা দিনের মত সাধারণ নয়।

বিকেল গড়াল, মাসি কপালে আর গালে সিঁদুর ছোঁয়ালেন তিথির। আজ বিজয়া।

“কি মিষ্টি লাগছে “- বলে তিথিকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে দিল নিয়ন, জড়িয়ে ধরে থাকল বুকের কাছে, চেপে ধরে রাখল। যতক্ষণ না বুঝতে পারল বুকের কাছের গরম নিশ্বাসটা আর নেই, আস্তে আস্তে আবার বিছানায় শুইয়ে দিল তিথিকে, চোখটা এখনও কথা বলছে যেন, শুধু সেই উত্তেজনাটুকু নিভে গেছে। নিয়নের চোখে ঝাপসা হয়ে এলো তিথির মুখ।

চোখ মুছে দরজার দিকে তাকাতেই থরথর করে কাঁপতে থাকা মাসিকে দেখতে পেলো নিয়ন। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাসিকে, “কিছু হয়নি মা, কিছু হয়নি।”

আজ বিসর্জনের দিন, হাওয়ায় ছাতিমের গন্ধ, চারিদিক শান্ত। মাসি গুমড়ে উঠে জড়িয়ে ধরে থাকলেন নিয়নকে, কিছু বলতে পারলেন না আজও, ঈশ্বর ওঁকে বলার শক্তি দেননি কোনদিনও।

©️শঙ্খচিল

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল