ভাঙা গড়ার খেলা —- কবিগুরুর সংসার

সোমা সরকার
5 রেটিং
3325 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 1 , গড়ে : 5]

পাঠকদের পছন্দ


_”তোমার সংসার- মাঝে, হায় তোমা-হীন
এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন —-
তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস টানে
তোমারে খুঁজিতে এসে  চাব কার পানে? 
আজ শুধু এক প্রশ্ন মোর মনে জাগে, 
মোর লাগি কোথাও কি দুটি স্নিগ্ধ করে 
রাখিবে পাতিয়া শয্যা চির সন্ধ্যা তরে? “
__ স্ত্রী মৃণালিনী মৃত্যুর পর কবির অন্তরের হাহাকার, হতাশা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘মরণ’ কাব্যগ্রন্থের উক্ত ৪ নং কবিতাটিতে ।
      আমরা অনেকেই কবি রবীন্দ্রনাথ কে চিনি তাঁর সৃষ্টির পাতা থেকে , কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন , আটপৌড়ে জীবনটা যে কতটা সুন্দর সাদামাটা ছিল তা অনেকেই হয়তো জানে না। কবির জন্মদিনে  একটু সেই সংসারের সংসারের চিত্রটা তুলে ধরতেই আমার এই লেখনী। 
       প্রথমেই বলে রাখি সুগৃহিনী সার্থক জননী মূর্তি বলতে যা বোঝায় মৃণালিনী বা ঠাকুর বাড়ির ছোট বৌ ছিলেন ঠিক তাই। পাত্রী সন্ধান করতে ঠাকুর বাড়ির বধূদের চিরাচরিত ‘আকর’ যশোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছিল । কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজির পরও যখন  মনোমত পাত্রীর সন্ধান পাওয়া গেল না তখন ঠাকুর স্টেটের  কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে (দশ বছরেরও কম বয়সী) ‘ভবতারিণীকেই পাত্রী, মনোনীত করা হলো। রবীন্দ্রনাথ মহর্ষিদেবের শেষ পুত্র। মা নেই- ,তাই
আড়ম্বরহীন নিতান্ত সাধারণ ঘরোয়াভাবেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘রবিজীবনী’। 

লেখক শ্রী প্রশান্ত কুমার পাল মহাশয় লিখেছেন
      ” অন্যান্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যশোহর গিয়েছিলেন
বটে,কিন্তু তিনি ভাবি বধুকে দেখে পছন্দ করেছিলেন কিনা বলা শক্ত।…… সম্ভবত পিতার দিক থেকেও কিছু চাপ ছিল। “
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লিখেছেন,  ‘ বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন  রবীন্দ্রনাথের মাতুল ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী।’
রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথ সেন প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন স্বহস্তে – লেখা একটি বিচিত্র বয়ানের পত্রে এবং ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য অনুষ্ঠানের ন্যায় এই অনুষ্ঠানটি ও সম্পন্ন হয়েছিল ব্রাহ্ম মতে। তবে রবীন্দ্রনাথের বিবাহের একটি একটি বিশেষত্ব এই যে, প্রথমতে বিয়ে করতে তিনি কন্যাপক্ষের বাড়িতে যাননি।  অর্থাৎ , তার বিবাহ বাসর বসেছিল ঠাকুরবাড়িতেই, তার কারণ সম্ভবত মর্যাদার বৈষম্য । ২৪ শে  অগ্রহায়ণ ,১২৯০ রবিবার তার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। 
হেমলতা ঠাকুরের( দীপেন্দ্রনাথ এর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী) বর্ণনায় পাওয়া যায়, 
“নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে  রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এলেন অন্দরমহলে — স্ত্রী আচারের সরঞ্জাম সেখানে সাজানো  । বরসজ্জার শালখানি গায়ে জড়ানো।……বিয়ের সময় কাকিমা ছিলেন খুব রোগা। গ্রামের বালিকা, শহুরের হাবভাব কিছুই জানতেন না। কি মানুষের সঙ্গে, তার বিয়ে হচ্ছে – সে যে কত বড় আশ্চর্য মানুষ, কাকে তিনি পেলেন , এর কোন ধারনাই তার ছিলনা । কণে এনে সাত পাক ঘুরানো হল — শেষে বরকনে দালানে চললেন সম্প্রদান-স্থলে । ………বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন । ভাঁড়কুলো,
খেলা আরম্ভ হলো, রবীন্দ্রনাথ ভাঁড় খেলার বদলে, 
ভাঁড় গুলো সব উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন — ওকি করিস  রবি ? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা ? ভাঁড়গুলো সব উল্টে পাল্টে দিচ্ছিস কেন? ” রবীন্দ্রনাথ বললেন “জানো না কাকিমা কাকিমা সব যে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে”
                 এই বাসরঘরেই এই তিনি গান জুড়েছিলেন :
                      ” আ মরি লাবণ্যময়ী 
                            কে ও স্হির সোদামিনী__……. “
দুষ্টুমি করে গাইতে লাগলেন কাকিমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। বেচারী কাকিমা রবীন্দ্রনাথের কান্ড দেখে 
জড়োসড়ো। “
দেবেন্দ্রনাথ পুত্রবধুকে আশীর্বাদ করে নাম দিয়েছিলেন ‘স্বর্ণ মৃণালিনী’ । ‘মৃণালিনী ‘ নামটা অবশ্য রবীন্দ্রনাথেরই, দেওয়া। বাড়ির ছোট বৌ বলে রবীন্দ্রনাথের কাছে এই মেয়ে ‘ছুটি’ ‘ভাই ছোট বৌ’ ,’ভাই ছুটি’ এই সব নাম পেয়েছিলেন, তবে এ সবই তার একান্ত ব্যবহারের ,একেবারে নিজস্ব। 
মৃণালিনী দেবীর বিদ্যাশিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল দক্ষিণডিহি গ্রামের একটি প্রাইমারি পাঠশালায় কিন্তু তা বেশিদূর এগোয় নি । বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির বধুর উপযুক্ত শিক্ষা দানের উদ্দেশ্য মহর্ষি তাকে লরেটো হাউজে ভর্তি করেন এবং এখানেই তার ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় ।আধুনিকতার সব শিক্ষায় তিনি পেয়েছিলেন এই পরিবারে। 

বিয়ের পর এই বালিকা বধূর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটি ঠিক কিরকম দাঁড়িয়ে ছিল তা বলা খুব শক্ত । কারণ, এত বড় মাপের একজন মানুষ – এত প্রতিভা , চারপাশে এত বিরাট সব মানুষদের আনাগোনা , দেশে-বিদেশে, ঘরে বাহিরে এত নারীসঙ্গ। তারপাশে মৃণালিনী দেবীর মত সাদামাটা এক নারীকে রবীন্দ্রপ্রেমীরা হয়তো মেনে নিতে পারেন না কিন্তু একটু গভীর ভাবে দেখলেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের সংসার-চিত্রটি একটু অগোছালো হলেও তা ছিল রসে বসে  বেশ কানায় কানায় পূর্ণ। 
  আসলে সাংসারিক পারিপাট্য বা শ্রীবৃদ্ধি বলতে যা বোঝায় – অর্থাৎ প্রচুর ধন-সম্পত্তি , স্ত্রীর গা ভর্তি গয়না, শাড়ি, বিলেতি আসবাবে সজ্জিত ডাইনিংরুম , দামী দামী বাসন পত্র — এর কোনোকিছুই ছিল না তার সংসারে। কবি যেমন তার রুচি বোধে স্বতন্ত্র – সাধারণ , কবিপত্নী ও স্বামীর আদর্শ অনুরাগের গতিমুখে পড়ে অত্যন্ত সহজ-সরল সংসার ধর্ম পালন করে গেছেন।  অসংসারী কবি চিত্তে সংসার আর কাব্যরচনা কখনো এক তলে চলতে পারে না। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি কোনদিনই গুছিয়ে সংসার করতে পারেননি। নিজেকে ও নিজের পরিজনকে সেই টানে টেনে নিয়ে ফিরেছেন এখান থেকে ওখানে । খেলা ভাঙার খেলায় মত্ত কবি কখনো স্থায়ী বাসা বাঁধতে পারেনি । তবে ভালোবাসায়  বাধ পড়েনি কখনও। প্রিয়নাথ সেন কে লেখা একটি পত্রে কবি আভাস দিয়েছিলেন;’ honeymoon কি কোনকালে একেবারে শেষ হবার কোন সম্ভাবনা আছে — তবে কি না moon এর হ্রাস-বৃদ্ধি পূর্নিমা-অমাবস্যা আছে বটে!’
  এ কথা ঠিক যে, প্রথমদিকে মৃণালিনীদেবীর কথায়, ‘যশুরে টান’ থাকায় তাকে নিজের সঙ্গে নিজেকেই লড়াই করতে হয়েছিল অনেক, কিন্তু আপন গুনে এই পরিবারের সকল সুখ দুঃখ আনন্দ-বেদনার  ভার বহন করেছিলেন কবিপত্নী। তাঁর প্রকৃত ক্ষেত্রটি ছিল সংসার সন্তানদের লালন-পালন। ‘যে ঘর বাঁধিলে তুমি সুমঙ্গল করে’- কবি পত্নীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই উচ্ছ্বাসই বুঝিয়ে দেয় বাস্তব চিত্রটি । মৃণালিনীর রূপকথার জগৎ থেকেই অবনীন্দ্রনাথ গেয়ে যান ‘ক্ষীরের পুতুল’ এর গল্পাংশ। এই বধূটি ভাসুরের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘নব নাটক’,  ‘সখী সমিতি’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি নাটকে। রান্নায় তার হাত ছিল চমৎকার ।নিত্য নতুন রান্না করা আর অপরকে সাজানোর মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন অপার আনন্দ।

এ গল্প অনেকেই জানেন, তবু একটু বলে দেই -ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে নিয়ে চলেছেন শান্তিনিকেতনে -সংসার পাততে ।হুকুম হয়েছে, ‘কোন অবান্তর ,বাহুল্য জিনিস নেয়া যাবে না’,হাঁড়ি-কড়াই,হাতা, খুন্তি -এসবই বাহুল্য বোঝা -অতএব নেয়া চলবে না ।
কবিজায়া সব শুনলেন কিন্তু যাওয়ার সময় সংগোপনে নিলেন সবই। শান্তিনিকেতনে আসার কিছুদিন পরেই গুরুদেবের অন্তরঙ্গ বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী এলেন শান্তিনিকেতনে। কবির তো কপালে ভাঁজ। কিভাবে হবে অতিথি সেবা! যথাসময়ে অতিথি আপ্যায়ন করলেন মৃণালিনী -তাঁর হাতের তৈরি আমের মিঠাই, মালপো ,চিঁড়ের পুলি প্লেটে সাজিয়ে  দিলেন কবিজায়া। অতিথিরা খেলেন চেটেপুটে ।কবি স্বীকার করে নিলেন স্ত্রীর সাংসারিক বিচক্ষণতা। 

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল