১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল। মজফফরপুর। রাত ৮ টা বাজতে চলেছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন দুই বিপ্লবী, ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি। গোয়েন্দাদের ফাঁকি দেবার জন্য তখন তাদের পরিচয় হরেন সরকার ও দীনেশ চন্দ্র রায়। ৮ টা বাজলো। তাঁদের উত্তেজনা বাড়লো। এখনই বেরোবে কিংসফোর্ডের গাড়ি। আজ এই অত্যাচারী অফিসারের শেষ দিন।কপাল জোরে বার বার বেঁচে যাওয়া এই অফিসারের আজ আর নিস্তার নেই। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে ব্রিটিশকে দেওয়া হবে চরম বার্তা। ভাবতে ভাবতেই ক্লাবের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে বেরোলো তাঁর কালো গাড়ি। নিখুঁত লক্ষ্যে আছড়ে পড়লো হেমচন্দ্র কানুনগোর তৈরি হাত বোমা। ৬ আউন্স ডিনামাইট, ব্ল্যাক পাউডার ফিউজ ও বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি সেই বোমা খণ্ড বিখণ্ড করলো ফিটন গাড়ি।বন্দেমাতরম ধ্বনিতে আকাশ মুখরিত করে দুই দিকে পালালেন দুই বিপ্লবী।
কিন্তু তাঁদের কপাল খারাপ। সেই গাড়িতে ছিলেন না অফিসার। ছিলেন মিস কেনেডি ও মিসেস কেনেডি নামের দুই ইউরোপীয় মহিলা। তাদের হত্যার ঘটনা রাষ্ট্র হয়ে গেল রাতের মধ্যেই। প্রতি স্টেশনে মোতায়েন হলো পুলিশ। সেই রাতেই ২৫ মাইল হেঁটে ওয়াইনী নামক স্টেশনে এসে পৌঁছলেন ক্ষুদিরাম। তার কাদা মাখা পা,বাঙালি পোশাক আর সন্দেহজনক আচরণ দেখে দুই কনেস্টবল জেরা শুরু করলেন। বেগতিক দেখে রিভলবার বার করলেন ক্ষুদিরাম। গুলি করার আগেই পুলিশ শক্ত হাতে ধরে ফেলল তাঁকে।পয়লা মে ১৯০৮ সাল গ্রেপ্তার হলেন ক্ষুদিরাম। সেই ওয়াইনি স্টেশন বর্তমানে পরিচিত ক্ষুদিরাম বোস পুসা নামে।পরদিন হাতকড়া পরিয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী হুড খোলা গাড়িতে করে মজাফফরপুরে নিয়ে এলো। সারা শহর ভেঙে পড়লো বিপ্লবীকে দেখতে। অবাক বিস্ময়ে দেখলো পুলিশের ঘেরাটোপে এক নবীন কিশোর, নির্ভীক নিষ্পাপ অবিচলিত মুখ। জনগনকে দেখে চিৎকার করে উঠলো বন্দেমাতরম।
২১ মে বিচার শুরু হলো তাঁর। তিন বিচারকের দুজন ছিলেন ভারতীয়। আর প্রধান বিচারক ছিলেন কর্নডফ।আদালতে সব দোষ স্বীকার করলেন ক্ষুদিরাম। বিচারের রায়ে ফাঁসির সাজা শোনানো হলো। রায় শুনে প্রফুল্ল হয়ে উঠলো তাঁর মুখ। কর্নডফ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি বুঝতে পেরেছো কি সাজা হলো তোমার? ক্ষুদিরাম গর্বের সাথে বললেন অবশ্যই।
সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক আইনজীবী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁর পক্ষে সওয়াল করতে এসেছিলেন। তিনি হতাশ হয়ে বলেছিলেন, তুমি সব দোষ স্বীকার করে নিলে!! প্রফুল্ল যেহেতু মারা গেছে,তার ওপর দোষ চাপিয়ে দিলে শাস্তি কমে যেত। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, এই কাজ করে আমি গর্বিত। টার্গেট মিস হলেও ব্রিটিশকে নড়িয়ে দিতে পেরেছি। অস্বীকার করবো কেন এই কৃতিত্ব? আদালতে সব দোষ স্বীকার করলেও শত প্রলোভন, অত্যাচারের মুখেও তিনি বিপ্লবী দল সম্পর্কে একটি তথ্যও দেন নি। বারবার জেরা করে হার মেনেছিল ব্রিটিশ।
তাঁর শেষ কদিন কারাগারে থাকার সময় তাঁকে সঙ্গ দিতেন আইনজীবী কালীদাস বাবু। তিনি লিখে গেছেন ক্ষুদিরামকে কারাগারে দেখার অভিজ্ঞতা। তাঁর মধ্যে কোনো দুর্বলতা, বিচলতা দেখা যায়নি কখনো। তিনি স্ফূর্তি তে থাকতেন।স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া করতেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা, ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডির জীবনী পড়তেন, গীতা ও আনন্দমঠ পড়তে চাইতেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, সুযোগ পেলে দেশের সব তরুনকে বোমা বানানোর ফর্মুলা শিখিয়ে দিতে চাই।
১০ ই আগস্ট ছিলো তাঁর জীবনের শেষ দিন। তিনি সারাদিনই ছিলেন স্বাভাবিক। কালিদাস বাবুকে বলেন, রাজপুত নারীরা যেভাবে আত্মাহুতি দিতেন সেইভাবে দেশের জন্য প্রান দিতে পারবেন ভেবে তিনি রোমাঞ্চিত। ফাঁসিতে যাবার আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খেতে চান।
১১ আগস্ট ভোরবেলা স্নান করে তিনি উৎসাহে ডগোমগো। তিনিই সবার আগে বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে এলেন। প্রসন্ন মুখ। নির্ভীক ভঙ্গিতে ১৫ ফুট উঁচু ফাঁসির মঞ্চে ধীর পায়ে হেঁটে উঠলেন। সবাইকে অবাক করে জল্লাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ফাঁসির দড়িতে মোম মাখায় কেন? তারপর উপস্থিত আইনজীবী, চিকিৎসকদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। জল্লাদ সবুজ ঢাকনা মুখে পরিয়ে দিলো। ঘটাং করে সরে গেলো পাটাতন। শেষ হয়ে গেল ভারতে সবচেয়ে কম বয়সি বিপ্লবীর জীবন। মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস বয়স তখন তাঁর।
জীবন শুরু হবার আগেই, যে জীবন হাসতে হাসতে তিনি দিয়ে দিলেন দেশের জন্য,সেই দেশ কী দিলো তাঁকে?গান্ধীজি নিন্দা করেছেন ক্ষুদিরামের। বিপথগামী বলে সমালোচনা করেছেন। আজকের ইতিহাস বইতেও ব্রিটিশের দেওয়া সন্ত্রাসবাদী তকমা রয়ে গেছে তাঁর গায়ে। অনেকের কাছেই ক্ষুদিরাম সেই বোকা লোকটা, যে বার খেয়ে খামোখা প্রাণটা দিলো। হাসির খোরাক মাত্র।
শুনি, দেখি আর ভাবি বোকা লোকগুলো ছিলো বলেই না আজ আমরা হাসতে পারছি। গান্ধীজির বিপথগামীরা ছিলেন বলেই আজ গান্ধীজির ছবি শোভা পাচ্ছে স্বাধীন দেশের টাকায়। দেশের মানুষ স্বীকৃতি না দিলেও ভারতের স্বাধীনতায় সশস্ত্র সংগ্রামের অবদান সসম্ভ্রমে মূল্যায়ণ করেছে ব্রিটিশ। এটাই তাঁর বড়ো স্বীকৃতি।
তিনি আছেন বাংলার চেতনায়, বাঙালির হৃদয়ে। নিজ মর্যাদায়। শহীদ দিবসে প্রনাম জানাই তাঁকে।
,,,, পার্থ চক্রবর্তী
তথ্য সূত্র উইকিপিডিয়া, এ কে আজাদ এর লেখা ‘ ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরামের শেষ কথা ‘।